আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন কার স্বার্থে? 

ব্যারিস্টার সালাহ্ উদ্দিন ভূঁইয়া

মতামত

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন কার স্বার্থে? 

ব্যারিস্টার সালাহ্ উদ্দিন ভূঁইয়া

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ কে এক ঐতিহাসিক আইন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

 ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচার করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই আইন প্রণীত হয়, যা ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ গঠনের বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।  

আইনটি ১৯৭৩ সালে প্রণীত হওয়ার পর ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় এসে এটি সংশোধন করে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করে এবং এই আইনের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী নেতাদের বিচারের মাধ্যমে আরেক অধ্যায়ের সূচনা করে।  
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্পোকসম্যানেরা সাম্প্রতিক ছাত্র নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের সময় হত্যা এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য শেখ হাসিনা সহ যাদের বিরুদ্ধে হত্যা এবং অন্যান্য মানবাধিকার অপরাধ করেছেন তাদেরও বিচার করা হবে বলেছেন।

 

শেখ হাসিনা সরকারের সময় বিরোধী দলের নেতাদের প্রতি ন্যায়বিচার ছিল নাকি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছিল? যদিও জামায়াতে ইসলামী নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ দীর্ঘদিনের এবং গুরুতর তবুও সমালোচকদের দাবি বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ছিল না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রমের স্বচ্ছতা, সাক্ষ্যপ্রমাণের মান এবং বিচারকদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

 শেখ হাসিনা সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ আইনের সংশোধনের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করলে, সরকারের পছন্দমতো বিচারক এবং প্রসিকিউটর নিয়োগ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।

 

সুশীল সমাজ এমনকি বর্তমান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যে আইনে হচ্ছে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১৯৭৩) সেই আইন আন্তর্জাতিক নয়, এটাতে অনেক ত্রুটি রয়েছে। এটা দিয়ে বিচার করলে তা হবে প্রহসন। সমালোচকদের মতে, বিচার প্রক্রিয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বিরোধী দলের নেতাদের বিশেষ করে জামায়াত-ই-ইসলামী দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। তারা এটিকে প্রহসনের বিচার বলে অভিহিত করে, যেখানে স্কাইপ কেলেঙ্কারীর মাধ্যমে আইন মন্ত্রণালয়ের রায়ে প্রভাব থাকার অভিযোগও ওঠে আসে। মানবতাবিরোধী অপরাধে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড রায় দেয়ার পর তার আইনজীবী তাজুল ইসলাম রায়ের পর তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন যে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়েছেন, সেটা গ্রহণ না করে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা হলেই সুবিচার হতো। এসব সাক্ষ্য-প্রমাণে মৃত্যুদণ্ড হওয়া দূরের কথা, এসব অভিযোগ দাখিলের জন্য প্রসিকিউশনের জরিমানা হওয়ার দরকার ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনার জুলাই মাসাকার অপরাধের বিচারের জন্য আইনজীবী তাজুল ইসলাম কে চীপ প্রসিকিউটর হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।  

তবে এ নিয়োগ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, প্রধান প্রসিকিউটর আগে জামায়াত নেতাদের পক্ষের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন। এতে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, সরকার প্রকৃত ন্যায়বিচারের পথে না গিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে কিনা। আইনজীবী তাজুল ইসলামের মেধা বা যোগ্যতা নিয়ে আমার কোন প্রশ্ন নেই, বড় প্রশ্ন দাড়িয়েছে তিনি কতটুকু নিরপক্ষতা বজায় রেখে কাজ করতে পারবেন ? 
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের ক্ষেত্রে যেহেতু ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক চলছে তাই ভবিষ্যতে বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে সরকারকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে বলে আমি মনে করি।
যেমনঃ ১.স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ মনোনয়ন প্রক্রিয়া: আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে নিরপেক্ষ প্যানেলের মাধ্যমে বিচারক ও প্রসিকিউটরদের নির্বাচন নিশ্চিত করা।
 ২. প্রার্থী নির্বাচন ও মূল্যায়ন: বিচারক ও প্রসিকিউটরদের অভিজ্ঞতা, নিরপেক্ষতা এবং মানবাধিকার আইন সম্পর্কে জ্ঞান যাচাই করে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে বিচারক ও প্রসিকিউটরদের নিয়োগ প্রদান।  
৩. স্বচ্ছতা ও জনসাধারণের প্রতি দায়বদ্ধতা: নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করে সকল তথ্য প্রকাশ করতে হবে এবং বিচার কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৪. আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ: আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়ার মান নিশ্চিত করা।  
আন্তর্জাতিক মডেল অনুসরণ করে বাংলাদেশের জন্য সুপারিশসমূহ: আর্জেন্টিনার "Trials of the Juntas" (১৯৮৫) এবং সিয়েরা লিওনের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল (২০০২-২০০৭)-এর মতো মডেলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনা সম্ভব। আর্জেন্টিনার "Trials of the Juntas" একটি উদাহরণ হতে পারে যেখানে সামরিক শাসনের সময় সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সামরিক কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছিল। এতে বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হয়েছিল, যা আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়। অথবা সিয়েরা লিওনের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল এর মত একটি বিশেষ আন্তর্জাতিক আদালত করতে পারে যেখানে আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় বিচারকরা একসাথে কাজ করেবে এবং এতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখা সহজ হয় এবং বিচারিক প্রক্রিয়া অধিকতর স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। সিয়েরা লিওনের বিশেষ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর টিম ছিল অভিজ্ঞ ও দক্ষ আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত, যারা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য কাজ করেছেন। এই প্রসিকিউটর টিমে আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় প্রসিকিউটররা একসাথে কাজ করেন, যা ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা ও বৈধতা নিশ্চিত করতে সহায়ক ছিল।  
উপসংহার বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর যথাযথ প্রয়োগ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা অপরিহার্য। আর্জেন্টিনা, সিয়েরা লিওন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মডেলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা সম্ভব। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে আস্থা অর্জন করতে পারবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে।

লেখক: ব্যারিস্টার সালাহ্ উদ্দিন ভূঁইয়া এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
news24bd.tv/ডিডি