ইসলামের দৃষ্টিতে ইন্টারনেট ব্যবহারে করণীয়

ইসলামের দৃষ্টিতে ইন্টারনেট ব্যবহারে করণীয়

 মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিন দিন মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট। আমাদের কাজের দক্ষতা, শিক্ষা, যোগাযোগ ও বিনোদনের উপায়গুলোকে নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। যেহেতু ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানের নাম, তাই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া নতুন এই অংশেও ইসলামের বিধি-বিধান অনুসরণ করতে হবে। প্রশ্ন জাগতে পারে, কোরআন-হাদিসে তো ইন্টারনেট সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই, তাহলে ইন্টারনেট ব্যবহারে তার বিধি-বিধান কিভাবে অনুসরণ করা হবে! এর উত্তর হলো ইন্টারনেট মূলত আমাদের দৈনন্দিনের মৌলিক কিছু কাজে প্রযুক্তির ছোঁয়া যোগ করেছে।

কিন্তু কাজগুলো হাজার বছর থেকেই মানুষ করে আসছে, ইন্টারনেট শুধু তার কর্মপদ্ধতি পরিবর্তন করেছে, গতি এনেছে, সশরীরে না বের হয়ে ঘরে বসেই অনেক কাজ সহজ করেছে। তাই মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করলে ইসলামের বিধি-বিধান বের করা সম্ভব ও সহজ। নিম্নে ইন্টারনেটের কিছু ব্যবহার ও বিধান তুলে ধরা হলো—
তথ্য ও জ্ঞান প্রাপ্তি : ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা যেকোনো বিষয়ে দ্রুত তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করতে পারি। অনলাইন এনসাইক্লোপিডিয়া, গবেষণাপত্র, ব্লগ ও ফোরামের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারি।

জ্ঞানার্জন ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ কাজ। পবিত্র কোরআন-হাদিসে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে বহু আয়াত ও হাদিস রয়েছে। কিন্তু জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে অবশ্যই নিয়ত পরিশুদ্ধ থাকতে হবে। নবীজি (সা.) বলেছেন, তোমরা এই উদ্দেশ্যে ইলম শিক্ষা করো না যে এর মাধ্যমে আলেমদের সঙ্গে গর্ব করবে বা মূর্খদের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হবে। কিংবা মজলিসের অধিকর্তা হবে। যে এমন করবে তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম, তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৭৭)

ইন্টারনেট যেহেতু বিশাল তথ্যভাণ্ডার, তাই সেখানে বহু ধরনের তথ্য পাওয়া যাবে। কিছু উপকারে আসবে, আবার কিছু ঈমান-আকিদায় বিভ্রান্তির বিষও প্রবেশ করাতে পারে। তাই ধর্মীয় বিষয়ে ইন্টারনেট থেকে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।

অবশ্যই বিজ্ঞ আলেমদের তত্ত্বাবধানে ধর্মীয় বিষয়গুলোর বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন ও বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলো বর্জন করতে হবে। কোনো তথ্য পেলেই তা যাচাই-বাছাই করে নেওয়া মুমিনের দায়িত্ব, বিশেষ করে যদি ধর্মীয় বিষয় হয়, তাহলে তা অবশ্যই যাচাই করতে হবে। তথ্যটি কে দিয়েছে, তার মতাদর্শ ও তাকওয়া সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছাড়া ইন্টারনেট থেকে নতুন কিছু পেলেই তা নিয়ে মাতামাতি করা উচিত নয়।
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, এই ইলমকে ধারণ করবে প্রত্যেক উত্তর-প্রজন্মের আস্থাভাজন শ্রেণি। তারা একে মুক্ত রাখবে সীমা লঙ্ঘনকারীদের বিকৃতি থেকে, বাতিলপন্থীদের মিথ্যাচার থেকে এবং মূর্খদের অপব্যাখ্যা থেকে। (শরহু মুশকিলিল আছার, হাদিস : ৩৮৮৪)

সহিহ মুসলিমের ভূমিকায় বিখ্যাত তাবেঈ হজরত ইবনে সিরিন (রহ.)-এর উক্তি রয়েছে, যেখানে তিনি বলেন, এই ইলম (কোরআন-সুন্নাহর ইলম) হচ্ছে দ্বিন। সুতরাং দেখে নাও, কার কাছ থেকে তোমরা তোমাদের দ্বিন গ্রহণ করছ। (মুসলিম শরিফ) 

তাই ইন্টারনেট থেকে ধর্মীয় বিষয়ে কোনো তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করতে হলে অবশ্যই কোনো বিজ্ঞ ও মুত্তাকি আলেমের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে, কোনো নতুন বিষয় পেলে সে বিষয়ে বিজ্ঞদের থেকে যাচাই করে নিতে হবে।

যোগাযোগ : ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা সারা বিশ্বের মানুষের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করতে পারি। ই-মেইল, সোশ্যাল মিডিয়া, মেসেজিং অ্যাপস এবং ভিডিও কলের মাধ্যমে আমরা বন্ধুবান্ধব, পরিবার ও সহকর্মীদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারি। অনেকে এর অপব্যবহার করে বিভিন্ন হারাম সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে যায়, যা ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। ইন্টারনেটনির্ভর যোগাযোগে জিনার গুনাহের পথ খুলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, চোখের ব্যভিচার হলো (বেগানা নারীকে) দেখা, জিহ্বার ব্যভিচার হলো (তার সঙ্গে) কথা বলা (যৌন উদ্দীপ্ত কথা বলা)। (বুখারি, হাদিস : ৬২৪৩)

যার দুটিই ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্ভব। তাই মুমিনের উচিত ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ ধরনের পাপ থেকে সতর্ক থাকা। ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে আরো বহু অপরাধ সমাজে প্রচলিত রয়েছে, সেগুলো থেকে বিরত থাকা।

বিনোদন : ইন্টারনেট আমাদের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন উপায় প্রদান করে। আমরা অনলাইনে মুভি, টিভি শো, মিউজিক, গেমস এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক কনটেন্ট উপভোগ করতে পারি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো ইন্টারনেটের অসুস্থ বিনোদনই বেশির ভাগ মানুষকে টানে। যেগুলো পাপে উদ্বুদ্ধ করে এবং আল্লাহর জিকির থেকে গাফেল করে। এর আসক্তি মানুষের শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও ধর্মীয় জীবনে প্রভাব ফেলে। পবিত্র কোরআনে এসব অনর্থক কাজের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, মানুষের মধ্যে কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য অসার বাক্য ক্রয় করে এবং আল্লাহর প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে, তাদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি। (সুরা : লুকমান, আয়াত : ৬)

অনেক তাফসিরবিদের মতে, এখানে অসার বাক্য বলতে হারাম গান, বাদ্য ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। তাই ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিনোদন গ্রহণের ক্ষেত্রে হারাম বিনোদনের ব্যাপারে সতর্ক থাকা মুমিনের দায়িত্ব।

বাণিজ্য ও অর্থনীতি : ইন্টারনেট আমাদের অনলাইনে কেনাকাটা, ব্যাংকিং এবং বিভিন্ন ব্যাবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ দেয়। ই-কমার্সের মাধ্যমে আমরা ঘরে বসেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারি। অনেকে এগুলোর আড়ালে প্রতারণার জাল পাতে। নিম্নমানের পণ্য কিংবা পণ্য না দিয়ে সরল মানুষদের সম্পদ হাতিয়ে নেয়, যা হারাম। অথচ আল্লাহর রাসুল (সা.) ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, প্রতারক ও ধোঁকাবাজদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। (তিরমিজি, হাদিস : ১৩১৫)

অনেকে আবার ইন্টারনেটে ব্যবসার নামে জুয়ার প্রচলন ঘটায়, উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের অল্প পুঁজিতে বেশি রুজির প্রলোভন দেখিয়ে হারাম জুয়ায় লিপ্ত করে। অথচ এটাও ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম।

সামাজিক যোগাযোগ : সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরমগুলোর মাধ্যমে আমরা আমাদের মতামত, ছবি, ভিডিও শেয়ার করতে পারি এবং বিভিন্ন কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত হতে পারি। এটা দ্বিন প্রচারেও সহায়ক হয়। কিন্তু এর অপব্যবহারের মাধ্যমে অনেকে আবার বিপথেও চলে যায়। অনেকে আবার এসব প্ল্যাটফরম থেকে সহজে উপার্জনের আশায় হারাম পন্থা অবলম্বন করে। এমনকি অশ্লীলতা পর্যন্ত ছড়ায়। অথচ আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই যারা এটা পছন্দ করে যে মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না। ’ (সুরা : নুর, আয়াত : ১৯)

অতএব, এসব প্ল্যাটফরম ব্যবহারের ক্ষেত্রেও মুমিনকে সতর্ক থাকতে হবে।

খবর ও আপডেট : ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা সর্বশেষ খবর, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, স্পোর্টস আপডেট এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে পারি। অনেকে আবার এই খবরগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকেই পেতে পছন্দ করি। অথচ সেখানকার খবরগুলো অনেক ক্ষেত্রে গুজবও হয়। কিন্তু আমরা না জেনেই সে গুজব ছড়ানোর কাজে অংশ গ্রহণ করে ফেলি। এতে নিজেদের ও সমাজের অনেক ক্ষতি করে ফেলি, বিশেষ করে জনমনে আতঙ্ক ছড়ায়—এমন কোনো তথ্য পেলে তা সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য কোনো সংস্থা থেকে নিশ্চিত না হয়ে প্রচার করা উচিত নয়। এ কারণেই মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘যখন তাদের নিকট নিরাপত্তার কিংবা ভয়ের কোনো সংবাদ আসে তখন তারা তা রটিয়ে দেয়। যদি তারা তা রাসুলের কিংবা তাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী (সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ) তাদের গোচরে আনত, তবে তাদের মধ্যে থেকে তথ্যানুসন্ধানীরা প্রকৃত তথ্য জেনে নিত। যদি তোমাদের প্রতি আল্লাহর দয়া ও করুণা না থাকত তবে তোমাদের অল্পসংখ্যক ছাড়া সবাই শয়তানের অনুসরণ করত। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৮৩)

এই আয়াতে ইন্টারনেটের খবর গ্রহণের ব্যাপারে মূলনীতি বলে দেওয়া হয়েছে। কারণ মানুষ ইন্টারনেটেই এমন হাওয়ার খবর বেশি পায়, আবার সেখানেই এসব খবর খুব রসালো করে রটায়। যার ফলে অনেক সময় বহু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। মুমিনের উচিত ইন্টারনেট থেকে খবর গ্রহণ ও শেয়ার করার আগে এই আয়াতের কথা বারবার স্মরণ করা।

মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সব ধরনের ফিতনা ও গুনাহের কাজ থেকে বিতর থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।