‘অর্থপাচারের মতো ক্যানসার চিকিৎসায় উচ্চমাত্রার এন্টিবায়োটিক জরুরি’

অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে ক্রেস্ট দিচ্ছেন ডিবেট ফরডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।

‘অর্থপাচারের মতো ক্যানসার চিকিৎসায় উচ্চমাত্রার এন্টিবায়োটিক জরুরি’

অনলাইন ডেস্ক

বর্তমানে ঋণ নির্ভরতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, দেশে রিজার্ভের পরিমাণ যেভাবে কমে যাচ্ছে তা শঙ্কার কারণ হতে পারে। আর্থিক খাতে সুশাসনে আমরা অনেকটা এগিয়ে ছিলাম, কিন্তু বর্তমানে কীভাবে পিছিয়ে গেলাম সেটাই বিস্ময়কর।  

শনিবার (২৫ মে) এফডিসিতে অর্থনৈতিক সুরক্ষায় আগামী বাজেটের কৌশল নিয়ে ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।  

ড. ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, ‘কর ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, বৈষম্য, দুনীর্তি ও অন্যায্যতা বহাল রেখে আসন্ন বাজেটে করারোপ করা হলে সেটি রাজস্ব আহরণে ভালো ফল দেবে না। রাজনীতিবিদ বা প্রভাবশালীদের চাপের কারণে রাজস্ব আহরণ যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ৮০ শতাংশ বিত্তবান কর ফাঁকি দিচ্ছে।

এত কম রাজস্ব আয় দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের বেতন চালানোই যাচ্ছে না সেখানে উন্নয়ন ব্যয় মেটাবে কীভাবে। ডিসি-ইউএনওদের দামি গাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়। ’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে আইএমএফ খুব বেশি জানে- এটি বিশ্বাস করার কারণ নেই। আইএমএফয়ের পরামর্শ দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তি দুবাই-সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিলিয়নিয়ারদের মধ্যে নাম লিখিয়ে ফেলেছে। তারা কোন দেশের নাগরিক সেটাও স্পষ্ট নয়। তারা কীভাবে টাকা আনা নেওয়া করছেন বাংলাদেশ ব্যাংক সে বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারছে না। ’

সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, অনিয়ন্ত্রিত দ্রব্যমূল্য বৈদেশিক ঋণের চাপ, আর্থিক খাতে অনিয়ম, প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ঘোষিত হচ্ছে আসন্ন বাজেট। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য সমাজে নীরব অসন্তোষ তৈরি করছে। রিজার্ভের ঘাটতির ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে। আমদানি ব্যয় বেড়েছে। দেশে বর্তমানে মোট অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকা। ক্রমান্বয়ে আমাদের কঠিন শর্তের ঋণ বাড়ছে, ডেট সার্ভিসিংয়ের বোঝা বাড়ছে। সে কারণে আমরা যে টাকাটা ঋণ হিসেবে নিচ্ছি তা সঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশে কর আহরণের পরিমাণ বিশ্বের সর্বনিম্ন। দেশের মানুষের মধ্যে কর না দেওয়ার মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। বছরে কোটি টাকা আয় করেন এরকম মানুষের মধ্যে  ৬৭ শতাংশ কর প্রদান করে না। নেপাল ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার চেয়েও কম আয়কর প্রদান করে আমাদের দেশের মানুষ। এমনকি কেনিয়া ও সিয়েরা লিয়নের মানুষ আমাদের চেয়েও বেশি আয়কর দেয়। ’

কিরণ আরো বলেন, ‘আমাদের দেশে বাজেট বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দুনীর্তি। বাজেট বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে কর আহরণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। কর আহরণ প্রক্রিয়ায় সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। শুধু রাজস্ব আদায় করেই অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। আর্থিক খাতে বর্তমানে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে। ঋণ জালিয়াতকারী, ঋণ খেলাপি, অর্থ পাচারকারীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অর্থপাচারের মতো ক্যানসার চিকিৎসা উচ্চমাত্রার এন্টিবায়োটিক ব্যবহার এখন জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক আরোপিত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করলে আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে না। তাহলে ধীরে ধীরে মানুষ ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে। ব্যাংকে নিরাপদে আমানত রাখার নিশ্চয়তা না থাকলে অর্থ পাচার বাড়বে। তাই রাজস্ব আয়ের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ালেও আর্থিক খাতে সুশাসন ও জবাবদিহিতা না থাকলে অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। ’

অর্থনৈতিক সুরক্ষায় আসন্ন বাজেটের কৌশল নিধার্রণে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান ১০ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করেন। এগুলো হলো:

১) খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে কৃষিবান্ধব বাজেট প্রণয়ন করা।  

২) পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি খাতে অপ্রয়োজনীয় প্রণোদনা কমিয়ে আনা।  

৩) নতুন কোনো প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা।  

৪) শেয়ার বাজারে ক্যাপিটাল গেইনের ওপর ট্যাক্স আরোপ করা।  

৫) যারা কর প্রদান করছে তাদের ওপর অযৌক্তিকভাবে করের বোঝা না বাড়িয়ে করের আওতায় বাড়ানো।  

৬) প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের ওপর প্রণোদনা ২.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা।  

৭) শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বরাদ্দ বাড়িয়ে এর আকার বৃদ্ধি করা।  

৮) আসন্ন বাজেটকে সামনে রেখে জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে গণমাধ্যম কমীর্দের প্রবেশ নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে তা নিরসন করা।  

৯) এনবিআরকে কর আহরণে কঠোর অবস্থান নিতে রাজনৈতিক সুরক্ষা প্রদান করা।  

১০) বাংলাদেশ রেলওয়ে, বিআরটিসি ও বিমানসহ লোকসানি খাতে বরাদ্দ প্রদানে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা।

news24bd.tv/আইএএম