ইসলামে সম্পদ উপার্জনের পন্থা

ইসলামে সম্পদ উপার্জনের পন্থা

 মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

ইসলাম আদর্শ মানুষ গঠনের একটি আদর্শ প্রক্রিয়া। সূচনালগ্ন থেকেই মানুষের জৈবিক ও আর্থিক চাহিদা দেখা দেয়। এ উদ্দেশ্যেই ইসলাম সম্পদ উপার্জন ও ব্যয়ের বৈধ-অবৈধ পন্থা সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে, যাতে মানবজাতি চলার পথে কোনোভাবে বিভ্রান্ত না হয়। মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে এসে ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইসলামে অর্থব্যবস্থা এভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে যে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নতুন অর্থ ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে না।

শুধু যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলির সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তুলে ধরতে হবে।

মানুষের বহুবিদ চাহিদার ভেতর অর্থনৈতিক চাহিদা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ এবং তার অস্তিত্বের সঙ্গে একাত্ম, সেই হেতু যাতে সমাজের কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোনোভাবেই অধিকতর সুবিধাভোগী হতে না পারে এবং অন্য একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বঞ্চিত হতে না পারে, সে জন্য ইসলামের অন্যান্য বিধানের মতো এ ক্ষেত্রেও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা প্রদান করেছে। ইসলাম অর্থ উপার্জন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে এমন সুন্দর উপায় বলে দিয়েছে, যেখানে একজন মানুষ অতি স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে মধ্য পন্থা অবলম্বন করে বৈধভাবে সম্পদ আহরণ-অর্জন করতে পারবে।

ইসলামের এই নীতিমালার লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।

তবে এ ক্ষেত্রে উল্লেখের দাবি রাখে যে ইসলামের অর্থব্যবস্থার ন্যায়ভিত্তিক বাস্তবায়নের সফলতা নিরঙ্কুশভাবে নির্ভর করে। সমাজে এর অন্য বিধিমালার সঠিক ও যথার্থ প্রয়োগের ওপর একটি ইসলামী সমাজব্যবস্থার ধারণা মোটামুটিভাবে নির্ভর করে কতগুলো মৌলিক নীতির ওপর। যেমন—

১. সর্বশক্তিমান আল্লাহর সার্বভৌমত্ব

২. ইতিহাসের কোরআনিক ধারণা

৩. উৎপাদন উপকরণের ধারণা

৪. সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের ধারণা

৫. সহাবস্থানের স্থায়ী নীতিমালা।

উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রতিটি ব্যাপক আলোচনার দাবি রাখলেও স্থানাভাবের কারণে এখানে তা সম্ভব নয়।

তবে ওই বিষয়গুলোর সঙ্গে সবাই কমবেশি পরিচিত বলে আশা করি বুঝতে পাঠকদের অসুবিধা হবে না। এ ছাড়া এসব বিষয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোচনার অবতারণা না করেও বলা যায়, কোনো ব্যক্তি বা সমাজ ওই নীতিমালার আলোকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন পরিচালনা না করে স্বেচ্ছাচারিতার কৌশল প্রয়োগ করে নিজেকে নিষ্কৃতির কোনো স্তরেই পৌঁছাতে পারবে না। কেননা সম্পদের চূড়ান্ত মালিকানা কেবলই মহান রাব্বুল আলামিন। পবিত্র কোরআনের ভাষ্য—‘আসমান ও জমিনের মধ্যে যা কিছু আছে, তার সার্বভৌমত্ব আল্লাহর। ’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১৭)

অতএব, দুনিয়ার যেখানে যে সম্পদ আছে তার স্রষ্টা যেমন আল্লাহ, তেমনি তার চূড়ান্ত মালিকও তিনি।

তবে মানুষ আল্লাহর মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে নির্ধারিত নীতিমালার আলোকে সাময়িকভাবে সম্পদ ভোগ করতে পারবে মাত্র, পুরোপুরি মালিক হিসেবে নয়।

এই আয়াতে এও বোঝা যায় যে ভূমি, পানি, বাতাস, আগুন ইত্যাদিসহ যেখানে যে সম্পদ আছে এগুলো বিনা মূল্যে আল্লাহ প্রদত্ত। মানুষ শুধু ইসলামী বিধানানুযায়ী প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের জন্য বিধিবদ্ধভাবে ভোগযোগ্য পণ্য ও সেবা উৎপাদন, আহরণ ও ভোগ করবে। আর তাতে অপচয় করা যাবে না।

ইসলাম কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কিংবা সমাজের ক্ষতিকর কাজে সম্পদ ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার সুযোগ রাখেনি। সম্পদ উৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইসলাম যে নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে তা নিম্নরূপ—

১. সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা, যেন কারো কোনো স্বার্থ ক্ষুণ্ন না হয়

২. জাকাত প্রদান করা

৩. আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা

৪. সুদ ও সুদি লেনদেন বন্ধ করা

৫. ব্যবসায়ে সব ধরনের এবং প্রকৃতির প্রতারণা পরিহার করা

৬. অপ্রয়োজনীয় সম্পদের মজুদ গড়ে না তোলা

৭. হারাম বস্তু উৎপাদন, বাজারজাত করণসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্মতৎপরতা থেকে বিরত থাকা

৮. মুনাফাখোরি ব্যবসা বা লেনদেন থেকে বিরত থাকা

৯. সমাজে বৈধ সম্পদের অব্যাহত সঞ্চালন নিশ্চিত করা, যাতে সহজেই ভোক্তার কাছে সম্পদ পৌঁছানো নিশ্চিত হয়।

১০. এ ছাড়া ইসলাম সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণের একটি বিশেষ পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে দিয়েছে। মৃত ব্যক্তির সম্পদ আত্মীয়দের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া। তবে তার কোনো আত্মীয় না থাকলে সে সম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া।

আমরা জানি, আমাদের সমাজসহ পৃথিবীর সব সমাজেই বৈধ-অবৈধ উপায়ে সম্পদ আহরণ ও ব্যয়ের প্রবণতা আছে। কিন্তু ইসলাম তার অনুসারীদের অবৈধ পন্থায় সম্পদ উৎপাদন, উপার্জন যেমন অনুমোদন দেয় না, তেমনি অবৈধ উপায়ে সম্পদ ভোগ-বণ্টনের অনুমতি দেয় না। ইসলাম উপার্জনের ক্ষেত্রে সামাজিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতেই বৈধতা ও অবৈধতার পার্থক্য সৃষ্টি করে দিয়েছে। এমনকি বৈধ উপায়ে যেসব ধন-সম্পদ উপার্জন করা হবে তা পুঞ্জীভূত করে রাখা যাবে না। কেননা এতে সম্পদের আবর্তন বন্ধ হয়ে যায় এবং ধন-সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বিনষ্ট হয়।

সম্পদ সঞ্চয়কারী নিজেই মারাত্মক নৈতিক রোগে আক্রান্ত হয় তা নয়, বরং সে সমাজের বিরুদ্ধে সব ধরনের জঘন্যতম অপরাধ করে এবং অবস্থানও নেয়। এই নীতিমালার আলোকে ইসলাম দৈনন্দিন জীবনের জন্য যেসব বস্তু ও কাজ অবৈধ করে দিয়েছে, সেগুলোর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক উল্লেখ করছি—

১. উৎকোচ আদান-প্রদান করা

২. ব্যক্তি-সমষ্টি-নির্বিশেষে সবার সম্পদ আত্মসাৎ করা

৩. চৌর্য কর্ম

৪. এতিম-অসহায়দের সম্পদ আত্মসাৎ

৫. মদ উৎপাদন, মাদকদ্রব্য এবং এসংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ড

৬. জুয়া এবং এমন সব উপায়-উপকরণ, যেগুলোর মাধ্যমে নিছক ঘটনাচক্রে ও ভাগ্যক্রমে একদল লোকের সম্পদ অন্যদলের কাছে স্থানান্তর

৭. ভাগ্য গণনা ও জ্যোতিষীর ব্যবসা

৮. মূর্তি গড়া, মূর্তি বিক্রয়, মূর্তির উপাসনা এবং এতদসংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ড ইত্যাদি।

ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে যেসব এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়েছে তার উদ্দেশ্য ছোট্ট পরিসরে উল্লেখ করছি—

১. ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য আদল প্রতিষ্ঠা করা

২. অর্থনৈতিক বিষয়ে দয়া প্রতিষ্ঠা করা

৩. সমাজে কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করা

৪. সমাজ থেকে অশোভনীয় কার্যাবলি দূরীভূত করা

৫. অযাচিত বোঝা ও শৃঙ্খল থেকে মানুষকে মুক্ত করা

৬. হালাল উপায়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা

৭. সম্পদের সর্বাধিক বিতরণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা

৮. সর্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিত করা

৯. সমাজে সহযোগিতার প্রবণতা উৎসাহিত করা

১০. সমাজের দুর্বল শ্রেণিকে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভে আনুকূল্য প্রদান করা ইত্যাদি।

আসুন, আমরা সবাই ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে ইসলামী জীবনাদর্শ রূপায়ণে তৎপর হই।

 

এই রকম আরও টপিক