ডিজিটাইজেশনে আইসিবির আর্থিক সক্ষমতা বাড়বে

অধ্যাপক সুবর্ণ বড়ুয়া।

সাক্ষাৎকার

ডিজিটাইজেশনে আইসিবির আর্থিক সক্ষমতা বাড়বে

অনলাইন ডেস্ক

দেশব্যাপী সেবা ছড়িয়ে দিতে ডিজিটাইজেশনে যাচ্ছে আইসিবি। মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পুঁজিবাজার উন্নয়নেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে দেশের সনামধন্য একটি পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেছেন আইসিবির চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগের অধ্যাপক সুবর্ণ বড়ুয়া। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. জয়নাল আবেদীন।

জয়নাল আবেদীন: দেশের আর্থিক খাত ডিজিটাইজেশন কতটা এগিয়েছে এবং আইসিবি এ নিয়ে কতটুকু কাজ করেছে?

সুবর্ণ বড়ুয়া: বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ হবে। আইসিবির চেয়ারম্যান হিসেবে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং দেশের প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি ‘স্মার্ট আইসিবি’ বিনির্মাণের কৌশলপত্র তৈরি করা হয়েছে। ওই কৌশলপত্রের অংশ হিসেবে ‘মাই আইসিবি বিনিয়োগ হাতের মুঠোয়’ নামের একটি নতুন অ্যাপ চালু করা হয়েছে, যার মাধ্যমে আইসিবির সব ধরনের সেবা পাবেন গ্রাহক। আইসিবি ক্যাপিটাল, আইসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট এবং আইসিবি ট্রেডিংয়ের সব ধরনের সেবা দেওয়া হবে সেই অ্যাপের মাধ্যমে।

অ্যাপটি এমএফএসের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, যার মাধ্যমে স্বল্প আয়ের প্রচুর মানুষ আইসিবির গ্রাহক হবে। সাধারণ এবং স্বল্প আয়ের বিনিয়োগকারীদের জন্য আমরা এরই মধ্যে নিম্ন ঝুঁকির ক্ষুদ্র বিনিয়োগ পণ্য ও সেবা তৈরি করেছি। এসব বিনিয়োগ আইসিবির অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা ব্যবস্থাপনা করবেন। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি অনেকটা কমিয়ে কাঙ্ক্ষিত আয়ের সুযোগ তৈরি হবে।

ফলে আইসিবির মাধ্যমে মার্কেটে ক্রমাগত নতুন ফান্ড ইনজেক্ট করার সুযোগ তৈরি হবে। একই সঙ্গে গ্রাহক বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ সরকারি প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাবে।

জয়নাল আবেদীন: দেশে বন্ড ফাইন্যান্সের সম্ভাবনা কতটুকু? পুজিবাজার এবং বন্ড বাজার এগিয়ে নিতে করণীয় কী?

সুবর্ণ বড়ুয়া: আমাদের দেশে বন্ডের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রচুর সুযোগ তৈরি হলেও এই মার্কেটটিকে আমরা যেভাবে দেখতে চেয়েছি সেভাবে গঠন করা যায়নি।

এর জন্য কাঠামোগত কিছু সমস্যা দায়ী। যেমন, বাংলাদেশের মানুষ এখনো বন্ডে বিনিয়োগের চেয়ে ব্যাংকে এফডিআর রাখতে বেশি পছন্দ করে। তারা ভাবে ব্যাংকে তাদের টাকা বেশি নিরাপদ। এ ছাড়া বন্ড না কিনে এফডিআর রাখার আরো একটি যৌক্তিক কারণ হচ্ছে আকর্ষণীয় সুদের হার। এফডিআর ও সঞ্চয়পত্র বন্ড মার্কেটের সরাসরি প্রতিযোগী।

ব্যাংকের এফডিআরের সুদের হার এবং বন্ডের কুপন রেট প্রায় কাছাকাছি। পাশাপাশি বাজারে ডিমান্ড ও সাপ্লাই দুদিকেই সমস্যা রয়েছে। বন্ড ইস্যু করে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ক্ষেত্রে কম্পানিগুলোর অনেক তথ্য বাজারে প্রকাশ করতে হয় এবং একটি পদ্ধতিগত ইস্যু ম্যানেজমেন্ট প্রক্রিয়ায় যেতে বেশ সময় লেগে যায়। পাশাপাশি অনেক কাগজপত্রের জোগান দিতে হয়, যা কম্পানিগুলো অনেক সময় এড়াতে চায়। প্রক্রিয়াগত এসব জটিলতার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ড ছাড়তে চায় না। আবার বিশ্বে  পেনশন ফান্ড, হেজ ফান্ডের মতো প্রাতিষ্ঠানিক অর্থ বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগ করা হয়, যা আমাদের দেশে নেই। আর সার্বিকভাবে বন্ডের যেহেতু ডিফল্ট রিস্ক থাকে, তাই ব্যাংকিং খাতের অভিজ্ঞতা থেকে বিনিয়োগকারীদের বন্ডমুখী করা কঠিন।

জয়নাল আবেদীন: তাহলে বন্ড মার্কেটের উন্নয়নে করণীয় কী?

সুবর্ণ বড়ুয়া: এই মার্কেটকে উন্নত করতে সরকারি উদ্যোগ খুব জরুরি। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। যেমন, সরকার উন্নয়নমূলক অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, যেখান থেকে সরকারের আয় হয়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার ব্যাংক বা বিদেশ থেকে ঋণ নেয়। সরকার চাইলে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে বন্ড মার্কেট থেকেও ঋণ নিতে পারে। এতে করে বন্ড মার্কেটের পরিধি এবং এর ওপর মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

পাশপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি, আধাসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারবাজারে বন্ড ও শেয়ার ইস্যু করলে বাজার ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে যাবে। তাই নতুন নতুন পণ্য ও সেবা নিয়ে আসার চেষ্টা করছে আইসিবি। আমরা দেশে প্রথম গ্রিন ইকুইটি আনার কাজ করছি, যেখানে পরিবেশবান্ধব ব্যবসা করছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তালিকাভুক্ত করা হবে।

জয়নাল আবেদীন: পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কমেছে। সংকট থেকে উত্তরণে আইসিবি কী ভূমিকা রাখছে?

সুবর্ণ বড়ুয়া: গত ৩০ বছরে যখনই পুঁজিবাজারের অবস্থা খারাপ হয়েছে তখনই আইসিবি পাশে দাঁড়িয়েছে। বাজারকে সাপোর্ট দিয়েছে। আমাদের বিশাল অঙ্কের পোর্টফোলিও মার্কেটে বিনিয়োগ করা আছে। এই মার্কেটের ওঠানামা থেকে ব্যবসা করে লাভ করতে পারলেই আমাদের পোর্টফোলিও আরো বাড়বে। তবে গত দুই বছরে সেই লাভটা আমরা করতে পারিনি। ফ্লোর প্রাইস থাকার কারণে ব্যবসা করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে আমাদের আর্থিক সক্ষমতা আগের চেয়ে দুর্বল হয়েছে।

জয়নাল আবেদীন: আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়াতে আপনারা সরকারের কাছে তহবিল চেয়েছেন, সেটির সর্বশেষ অবস্থা কী?

সুবর্ণ বড়ুয়া : তহবিল সহায়তা নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। আশা করছি চলতি বছরের মধ্যে একটি পজিটিভ রেজাল্ট পাওয়া যাবে। সহায়তা পাওয়া গেলে তা দিয়ে নানা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া উচ্চ সুদে অর্থায়ন ফেরত দেওয়া হবে এবং এর একটি অংশ বাজারে বিনিয়োগ করা হবে। ফলে একদিকে যেমন বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আইসিবি আরো শক্তিশালী ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, অন্যদিকে নিজের আর্থিক সক্ষমতাকেও টেকসই করতে পারবে।

জয়নাল আবেদীন: ব্যাংক খাতে বর্তমানে মার্জার চলছে। এটি কিভাবে সফল করা যায়?

সুবর্ণ বড়ুয়া: ব্যাংক মার্জার প্রক্রিয়াটি শুরু করা প্রয়োজন ছিল। আমি মনে করি এটি আমাদের জন্য ভালো হবে। এখানে আইসিবিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। একটি মার্জারের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কয়েক বছর লেগে যায়। এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি। আইসিবি ও আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড এ ধরনের কাজে পারদর্শী। ফলে আশা করব ব্যাংক মার্জারগুলো সফলভাবে সম্পন্ন করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইসিবিকে সম্পৃক্ত করবে।

জয়নাল আবেদীন: আইসিবিকে এগিয়ে নিতে আর কী কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন?

সুবর্ণ বড়ুয়া: এ ক্ষেত্রে সবার আগে বলতে হয়, বিনিয়োগ নীতিমালা নতুন করে সাজানো হচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিনিয়োগ নীতিমালা হলে আইসিবি আগের চেয়ে আরো ভালো এবং সাসটেইনেবল বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা করতে পারবে। আশা করছি, চলতি বছরের জুনের পরেই নতুন বিনিয়োগ নীতিমালা কার্যকর হয়ে যাবে।

জয়নাল আবেদীন: পুঁজিবাজার গতিশীল করতে আপনার প্রস্তাব কী?

সুবর্ণ বড়ুয়া: পুঁজিবাজারের উন্নয়নে অবশ্যই ভালো কম্পানিগুলোকে বাজারে নিয়ে আসতে হবে। তাদের আগ্রহী করার পাশাপাশি নতুন পণ্যের উদ্ভাবন খুব গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে বেশি মানুষকে পুঁজিবাজারে সম্পৃক্ত করতে হবে। বাজারে প্রযুক্তির সন্নিবেশের বিকল্প নেই। জনসাধারণের কাছে প্রমাণ করতে হবে, পুঁজিবাজার তাদের সম্পদ তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এর জন্য সাধারণ মানুষকে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যবস্থাপকদের মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে হবে। এসব পদক্ষেপ সফল হলে বাজারের ব্যাপ্তি ও গভীরতা বাড়বে এবং পুঁজিবাজার আরো স্থিতিশীল হবে।

জয়নাল আবেদীন: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

সুবর্ণ বড়ুয়া: আপনাকেও ধন্যবাদ।

news24bd.tv/DHL