দক্ষিণকে নিয়ে কেনো ভীত উন্নত বিশ্ব?

সংগৃহীত ছবি

দক্ষিণকে নিয়ে কেনো ভীত উন্নত বিশ্ব?

অনলাইন ডেস্ক

উন্নয়নশীল বিশ্ব বা গ্লোবাল সাউথের উত্থানপর্ব চলছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে চীনের অগ্রগতি, ব্রিকসের সম্প্রসারণ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের বিরুদ্ধে লাতিন আমেরিকার জেগে উঠা এই উত্থানের পেছনে অবদান রাখছে। কয়েক দশক ধরে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত মার্কিন প্রভাবের বিপরীতে একটি নতুন বহুজাতিক বিশ্ব ব্যবস্থার উদ্ভব হচ্ছে, আর এতে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কায় ভুগছে উন্নতির শিখরে থাকা পশ্চিমা বিশ্ব।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার উন্নয়নশীল বিশ্বের এই উত্থানকে স্বাগত জানানোর বদলে মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

উন্নয়নশীল বিশ্ব কি চায় সেটা না বুঝে উল্টো তাদের অস্তিত্বকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে উন্নত বিশ্ব। দেরীতে হলেও উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতারা বুঝতে পেরেছেন তারা সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের বন্ধনে একে অপরের সাথে আবদ্ধ। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিটিরই বেশ কিছু চাপা ক্ষোভ ও দাবি আছে যা বেশিরভাগ সময় এড়িয়ে যায় উন্নত বিশ্ব।

পঞ্চাশ বছর আগে তৃতীয় বিশ্ব নামে পরিচিত অঞ্চলের দেশগুলো বিশ্ব অর্থনীতিকে পাল্টে দিতে এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেকগুলো দেশ উপনিবেশবাদ থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনভাবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশগুলো খুব একটা উন্নতি করতে পারেনি। এই দেশগুলোর জন্য রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বে রূপ নিতে পারেনি, কারণ বৈশ্বিক অর্থনীতি কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পশ্চিমা দেশের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং উপনিবেশবাদের কবল থেকে তখনও পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতি পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি।

১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুংয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নেতারা এক নতুন অস্তিত্ব বিনির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক প্রথম বিশ্ব এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন্দ্রিক দ্বিতীয় বিশ্বের সাথে মিল রেখে উন্নয়নশীল দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের আন্দোলন নামে এক নতুন কর্মসূচি উদ্বোধন করে। পরবর্তী দশকগুলোকে এশিয়ান, ক্যারিবিয়ান, আফ্রিকান ও লাতিন আমেরিকান দেশগুলোর এই জোট জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন ও গ্রুপ অব সেভেন্টি সেভেন নামে পরিচিত হয় এবং উপনিবেশবাদ ও নব্য উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত সংগ্রাম শুরু করে। বান্দুং সম্মেলনের ২০ বছর পড়ে এই আন্দোলনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জয় অর্জিত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বে নিজেদের মিত্রদের সমর্থন এবং তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর অর্থনৈতিক শক্তিকে পুঁজি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোট ১৯৭৪ সালের ১ মে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গঠনের জন্য দুটি যুগান্তকারী প্রস্তাবনা গ্রহণ করে। একটি ছিল ঘোষণা, অপরটি ছিল কর্মসূচি, এবং উভয়ের উদ্দেশ্যই ছিল নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রবর্তন। এই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ ছিল সহজ, এবং তা হলো বিশ্ব অর্থনীতির নিয়মকানুনগুলো অযৌক্তিক এবং দরিদ্র দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগুলোকে পরিবর্তন করতে পারলেই উন্নয়ন সম্ভব। পুরো ধারণাটি উন্নত বিশ্বের নেতা যুক্তরাষ্ট্রের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত হওয়াতেই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত।

জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী, বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ, বিদেশি দখলদারিত্ব, বর্ণবাদী অবিচার, জাতিগত বৈষম্য এবং নব্য ঔপনিবেশিকতা দ্বারা পরিপূর্ণ। এগুলোর কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পূর্নাঙ্গ মুক্তি ও উন্নতি সম্ভব হচ্ছে না। উন্নয়ন অর্জিত হতে হলে বিশ্বব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দরকার, যা সম্ভব হবে যদি উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর পূর্ণ অধিকার দেয়া হয়, প্রযুক্তিকে কুক্ষিগত করে রাখা না হয়, বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করা হয়, ঋণের বোঝা থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে মুক্ত করা হয়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো সংস্থাগুলোকে গণতান্ত্রিক করা হয় এবং বাণিজ্য ও অর্থায়নের ক্ষেত্রে দরিদ্র দেশগুলোকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়। জাতিসংঘের প্রস্তাবনায় এই বিষয়গুলোর ওপরেই জোর দেয়া হয়েছিল।

কেউ আশা করেনি যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর এই দাবিগুলো সহসাই অর্জিত হবে। তবে এগুলোর মধ্য দিয়ে একটি অধিক সমতাভিত্তিক বৈশ্বিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বের পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

জাতিসংঘের এই প্রস্তাবনা গৃহীত হওয়ার পরবর্তী বছরগুলোতে তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতা হ্রাস পায়। স্নায়ু যুদ্ধের সময়ে এই আন্দোলনের প্রধান দেশগুলোর পতন ঘটে। তৃতীয় বিশ্বজুড়ে মার্কিন সহায়তায় ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে থাকে, দরিদ্র দেশগুলোর ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। ঋণগ্রস্ত দেশগুলোকে আইএমএফের ঋণ গ্রহণে বাধ্য করা হয়, এবং সংস্থাটির শর্তাবলী দরিদ্র দেশগুলোকে পঙ্গু করতে থাকে। সর্বোপরি, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে তৃতীয় বিশ্ব তাদের প্রধান মিত্রকে হারিয়ে ফেলে।

এসকল ঘটনার ফলে বৈশ্বিক উন্নয়নের এক নতুন যুগ শুরু না হয়ে বরং উন্নয়নের হারানো যুগের আবির্ভাব ঘটে। বিশ্বব্যাপী অসমতা বৃদ্ধি পায়, এবং বৈশ্বিক দারিদ্র্যতা নিরসনের ক্ষেত্রে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে নতুন বিশ্বব্যবস্থা সৃষ্টির সিদ্ধান্ত অতীতে হারিয়ে যাওয়া একটি ঘটনায় পরিণত হয়।  
পশ্চিমা বিশ্বে এই ঘটনাকে শুধু যে ভুলে যাওয়া হয়েছে তাই নয় বরং যেসকল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা এই ঘটনাকে প্রভাবিত করেছিল সেগুলোকে কখনৈ বুঝার চেষ্টা করা হয়নি। নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন অর্জনে যেসকল বাধা রয়েছে সেগুলোকে আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। গ্লোবাল সাউথের অধিকাংশের কাছে গ্লোবাল নর্থের নেতা যুক্তরাষ্ট্র ধোঁকাবাজ হিসেবে পরিচিত। এই কারণেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এখনও ভালো থাকার আশায় সংগ্রাম করে যাচ্ছে।

গ্লোবাল সাউথ যদি আবারও শক্তিশালী হয় তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পাড়ে। তবে হয়তোবা এটাই সবার জন্য ভালো হবে, বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনের সন্ধান পাবে।

গ্লোবাল সাউথের নেতারা নতুন বিশ্বব্যবস্থা সৃষ্টিকে পশ্চিমা বিশ্বের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেননি, বরং জাতিসংঘের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের উন্নতির মাঝে গভীর আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে।

গ্লোবাল সাউথ শক্তিশালী হলে হয়তোবা নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে, কিন্তু তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এর মধ্য দিয়ে বহুদিন ধরে পেছনে পড়ে থাকা স্বপ্ন সত্যি হবে।

স্বপ্নগুলো হচ্ছে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা এবং সকলের জন্য সুখ ও সমৃদ্ধির জীবন।

সূত্রঃ ফরেইন পলিসি

লেখকঃ মাইকেল গ্যালান্ট, অড ডার্নাল

news24bd.tv/ab