পদ্মায় অবৈধ বালু উত্তোলন, দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন

নদীতে অবৈধ ড্রেজার

পদ্মায় অবৈধ বালু উত্তোলন, দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন

শরীয়তপুর প্রতিনিধি: 

শরীয়তপুরের জাজিরার পদ্মা নদীতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। গেলো দুই সপ্তাহে নদীতে বিলীন হয়েছে কয়েক বিঘা ফসলি জমি ও বসতঘর। আর ভাঙন আতঙ্কে এলাকা ছেড়েছে অন্তত দেড়শো পরিবার।  

ঝুঁকিতে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদসহ পাঁকা স্থাপনা।

রাতের আধারে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।  

সরেজমিনে ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জাজিরা উপজেলার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পাইনপাড়া আহাম্মেদ মাঝির কান্দি এলাকাটি পদ্মা নদীর উত্তর তীরবর্তী চরাঞ্চল। দেড় হাজার পরিবার দীর্ঘদিন ধরে এখানে বসবাস করে আসছেন। চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে এই এলাকার হাকিম আলী মজুমদারের বাড়ি থেকে মতি মাঝির বাড়ি পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকা ভাঙনের শিকার হয়েছে।

 

গত দুই সপ্তাহ ধরে এই ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভাঙনের শিকার হয়ে অন্তত দেড়শো পরিবার তাদের বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। এছাড়াও নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ফসলি জমি, গাছপালা, মসজিদ।  

বর্তমানে ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে পাইনপাড়া মাঝিকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মফিজুল উলূম নূরানী মাদরাসাসহ আরও ৩০০ বাড়িঘর। অনেকেই ঘরবাড়ি সরিয়ে পদ্মা দক্ষিণ প্রান্তের এলাকা মঙ্গল মাঝির ঘাট এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন।

জাজিরা উপজেলার পাইনপাড়া আহমদ মাঝির কান্দি এলাকার বাসিন্দা শাহিন মাঝি ও তার ভাই আনোয়ার মাঝি। স্ত্রী সন্তান নিয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এই এলাকায় বসবাস করে আসছেন তারা। হঠাৎ করে ভাঙন শুরু হলে গত দুই সপ্তাহে নদীতে বিলীন হয়ে যায় তাদের ২০ বিঘা ফসলি জমি। এছাড়াও ভাঙ্গনের মুখে থাকায় বসতবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন অন্যত্র।  

দীর্ঘ দিন ধরে পদ্মা সেতুর নিকটবর্তী এলাকায় বালু উত্তোলনের ফলে তাদের এই দুর্দশা বলে জানায় ভুক্তভোগী এই দুই ভাই। দ্রুত বালু উত্তোলন বন্ধের পাশাপাশি টেকসই বেড়িবাঁধের দাবি তাদের।

শাহিন মাঝি বলেন, আমরা ১৫ বছর ধরে এখানে বসবাস করি। পদ্মা সেতুর পাশে একটি চক্র বালু কাটায় ভাঙনের সমস্যায় পড়েছি। আমাদের এলাকার শত শত মানুষের ঘরবাড়ি নদীতে চলে গেছে এই ড্রেজারের কারনে। প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এখনো তেমন ব্যবস্থা নেয়নি। আমরা এখন ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে চলে যাচ্ছি। যদি ড্রেজার বন্ধ করা ও বেড়িবাঁধ করা হলে তাহলে বাকি পরিবারগুলো থাকতে পারবে।  

শাহিন মাঝির ভাই আনোয়ার মাঝি বলেন, আমাদের ৩০ বিঘা জমির সব নদীর মধ্যে চলে গেছে। ভাঙতে ভাঙতে এখন নদী একদম আমার ঘরের কাছাকাছি চলে আসছে। আমরা প্রাণ বাঁচাতে বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে চলে যাচ্ছি। কই যাবো তার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নাই। বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের দাবি দ্রুত তারা যেন আমাদের পাশে দাঁড়ায়।

নদী ভাঙনের শিকার হয়ে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগী ও স্ত্রী পরিজন নিয়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিচ্ছেন একই এলাকার মুনসুর আলী টেপা। তার এই গন্তব্য অজানার উদ্দেশ্যে। একসময় ৫ বিঘা সম্পত্তির মালিক থাকলেও এখন নতুন করে ঘর বাঁধার নেই জায়গাটুকুও। নদীতে অবৈধ ড্রেজার চলার কারনে ভাঙনে বিলীন হয়ে আজ তিনি গৃহহীন। সরকারের কাছে ঘর করার জন্য একটুকু জায়গার দাবী জানিয়েছেন ভুক্তভোগী মানুষটি।  

মুনসুর আলী টেপা বলেন, দিনরাত বালু নদীতে বালু কাটে। আমার ৫ বিঘা জমির আর কিছুই নাই, সব নদীতে চলে গেছে। আমি এখন কোথায় বাড়িঘর তৈরি করবো তার কোনো ঠিক নাই। সরকারের কাছে একটাই দাবি আমাকে একটু ঘর করার জায়গা দিক, আর এই এলাকায় পাঁকা বেড়িবাঁধ দিক।

এদিকে নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে বাঁধা দিলেও থামছে না বালু খেকোরা। পদ্মা সেতুর উন্নয়ন প্রকল্পের দোহাই দিয়ে প্রশাসনের সহায়তায় রাতভর বালু উত্তোলন করেই যাচ্ছে চক্রটি। আর চক্রটির বিরুদ্ধে কথা বললেই হয়রানি করেন বলে অভিযোগ  ভুক্তভোগীদের।  

আনোয়ার বেপারী নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, আমি গতবছর ড্রেজার চালাতে বাঁধা দেওয়ায় আমার ট্রলারটি আটকিয়ে রেখেছিল তারা। পরে আমি টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনি। বছর বছর এভাবেই নদীতে মাটি কাটায় আমরা বিপদে পড়ি। তারা প্রশাসনকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে এগুলো করছে। সরকারের কাছে একটাই চাওয়া দ্রুত এই ড্রেজার বন্ধ করা হোক।

আজিজ মল্লিক নামের এক ব্যক্তি বলেন, বাপ-দাদার ভিটা ছাইড়া চলে যাইতাছি। ভাবছিলাম আমাদের এই চরটা ভাঙবো না। কিন্তু রাতের বেলা শত শত ড্রেজার চালানোয় আজ আমাদের সব নদীতে চলে গেলো। তাদের বাঁধা দিলে বলে, তারা নাকি উপর মহল থেকে পারমিশন এনেছে। আমাদের কথা তারা শুনে না।

ভাঙনের ব্যাপারে শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সুমন চন্দ্র বনিক, গতবছর পাইনপাড়া এলাকায় ভাঙ্গন রোধে জিও ব্যাক ফেলা হয়েছিল। এ বছর অর্থ বরাদ্দ না থাকায় জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা সম্ভব হয়নি। অর্থ বরাদ্দ চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু করা হবে।

এ ব্যাপারে জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া ইসলাম লুনা বলেন, ইতোমধ্যে ভাঙনের শিকার মানুষের তালিকা করে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া গত দুই দিনে দুটি অবৈধ ড্রেজার জব্দ করা হয়েছে। চক্রটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নিয়মিত অভিযান চালানো হবে বলে।

news24bd.tv/কেআই