ভুল ওষুধে ২২ বছর, ‘দানবীয়’ চেহারা নিয়ে ঘুরছেন বাবুল মিয়া 

ভুল ওষুধে ২২ বছর, ‘দানবীয়’ চেহারা নিয়ে ঘুরছেন বাবুল মিয়া 

গাজিপুর প্রতিনিধি

বিশাল দেহ, বিকৃত লম্বাটে মুখে অস্বাভাবিক নাক ও কান, হঠাৎ করে দেখলে যে কারো গা শিউরে উঠবে। ভয় পেতে পারেন দুর্বল চিত্তের মানুষেরা। যার কথা বলছি, তিনি বাবুল মিয়া। গাজিপুরের বাসিন্দা তিনি।

জানা গেছে, ভুল ওষুধে ২২ বছর ধরে ‘দানবীয়’ চেহারায় ভুগছেন বাবুল মিয়া।

বাবুল মিয়া দেখতে স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে একটু আলাদা হওয়ায় হারিয়েছেন চাকরি। অভাবের সংসারে পরিবারের দু-বেলা দুমুঠো ভাত জোগাড় করতে এখন অটোরিকশা চালান তিনি। সেখানেও যেন বিপত্তির শেষ নেই।

অদ্ভুত চেহারার কারণে আর দশজনের মতো যাত্রী পান না বাবুল।  

বাবুলের এক প্রতিবেশি জানান, 'প্রথম দেখাতে আমার গা শিউরে উঠছে আমি ভয় পেয়ে গেছি, যে এ-রকম মানুষ কখনও দেখি নাই, দানব আকৃতির মানুষ।
দেখতে দেখতে ভয় কেটে গেছে অনেক প্রতিবেশির। তবে, তাকে প্রথম দেখায় বেশি ভয় পায় শিশুরা'।

ভুক্তভোগী বাবুল মিয়া বলেন, 'আগে চাকরি করতাম সিকিউরিটিতে পরে চাকরি যাওয়ার পরে আমি গাড়ি কিনি, অনেকেই উঠতে চায়ত না, আমার গাড়ি রেখে অন্য গাড়িতে উঠত, এখন মোটামোটি উঠে।
 
এক অটো ড্রাইভার বলেন, 'আমরা তো প্রথম প্রথম ভয় পাইতাম দানব আকৃতির চেহারা দেইখা, এখন আমাদের সাথে গাড়ি চালায়, এখন আর ভয় নাই'।

ভূপৃষ্ঠে এ যেন ভিন্ন গ্রহের কোনো প্রাণির বিচরণ। মানুষ হয়েও তার বাস্তবতা যেন মানুষের সাথে দানবের বেচেঁ থাকার লড়াই। প্রথম প্রথম মুখে গামছা পেঁচিয়ে নিজেকে আড়াল করে অটোরিকশা চালাতেন বাবুল মিয়া।

এ ব্যাপারে বাবুল মিয়া বলেন, 'ফেস দেখলে যদি অনেকে উঠতে না চায় সে জন্য মুখে গামছা বেধেঁ প্রথম প্রথম গাড়ি চালাইতাম'।

তবে, অন্যা শিশুরা ভয় পেলেও নিজের বাবাকে ভয় পায় না বাবুল মিয়ার ছেলে আলিফ। নিজের বাবাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবাদের একজন বলে মনে করে সে। বাবুলের ছেলে আলিফ বলেন, 'আমার বাবা আমাকে আদর করে কিন্তু অন্য বাচ্চারা তাকে দেখে ভয় পায়, কিন্তু আমি ভয় পাই না, আমার আব্বু অনেক ভালো'।

বাবুল মিয়া স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে ভিন্ন হলেও তার সাথে কথা বলে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছেন বলে জানান তার স্ত্রী। প্রথম দেখাতে খারাপ লাগলেও পরবর্তীতে তার কথাবার্তা ও সদ্ব্যবহারে আকৃষ্ট হয়েছেন বলে জানান তিনি।  

বাবুল মিয়ার স্ত্রী বলেন, 'একজন মানুষের সবকিছু ওপর থেকে বোঝা যায় না, সে কিন্তু মানুষ। সেভাবে আমি দেখছি কথা বলছি, দুইজনে কথা বইলা দেখলাম সবাই তো ভালো নিয়া সংসার করে আমি দেখিতো মানুষটারে কাছে পাইয়া বা ওর হাত ধইরা দেখিতো এই মনে কইরাই আমি বিয়া করছি'।

বিরাট মুখমণ্ডল আর দানব আকৃতির চেহারা হলেও বাস্তবে একজন সাদা মনের মানুষ বাবুল মিয়া। ব্যক্তিগত জীবনে সে খুবই সহজ সরল মনের অধিকারী বলে জানান সহকর্মী অটোরিক্সা চালক ও তার প্রতিবেশিরা।  

এলাকার লোকজন জানান, 'উনি মানুষ হিসেবে ভালো। উনি আমাদের সাথে কোনো রকম খারাপ ব্যবহার করেনি। সবসময় ভালো ব্যবহার করেছে, আমরাও উনার সাথে ভালো ব্যবহার করেছি'।

বাবুল মিয়ার অস্বাভাবিক চেহারা দেখে ভয় পায় লোকজন। একান্তভাবে কেউ তার সাথে মিশতে চায় না। বাসা ভাড়া নিতেও পড়তে হয় বিপাকে। তাই, সংগ্রামী জীবনের বাস্তবতা বড্ড করুণ বলে আক্ষেপ করেন তিনি। বলেন, 'প্রথম যেখানেই যাইতাম লোকজন তাকায় থাকতো আবার লোকজন ভিড় করত দেখার জন্য… বলতে পারি না কীভাবে বুঝাব তাদেরকে যে আমার মতো তাদেরও তো হতে পারত এরকম, আমার হয়ত একটু ভুলের কারণে এমন হইছে। কিন্তু আমার মত অন্য কারো যেন এমন না হয়'।

ছোটবেলা থেকে চেহারা ভালোই ছিল বাবুল মিয়ার। দৃষ্টিশক্তি নিয়ে সমস্যায় পড়ায় চিকিৎসকের পরামর্শ না মেনে অতিরিক্ত ওষুধ সেবনের কারণে আস্তে আস্তে তার চেহারার এমন বিকৃতি ঘটে বলে মনে করেন তিনি।

বাবুল মিয়া বলেন, 'আমার ছোট বেলা থেকে চেহারা ভালোই ছিলো। ২০০২ সাল থেকে আমার চোখে সমস্যা হয়, সন্ধ্যা হলে আমি কিছু দেখতে পারতাম না, পরে ভিটামিনের অভাবে নাকি এমন হইত পরে আমাকে একজন বুদ্ধি দিলো ইটিক্যাপসেল খাইতে। পরে ‍আমি ফার্মেসি থেকে কিনে খাই, সপ্তাহে ১টা করে খাওয়া দরকার আমি দিনে ৩টা করে খাইতাম। না বুঝে খাইছিলাম। খাওয়ার পরে আস্তে আস্তে চেঞ্জ হওয়া শুরু করে'।

বাবুল মিয়ার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া একমাত্র ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন গাজীপুরের শ্রীপুরের কেউয়া পশ্চিম খন্ড গ্রামে। অভাবের সংসারে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেয়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখে আছেন বলে জানান তার স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন। এ অবস্থায় মানবিক সাহায্যের আবেদন করেন তিনি। বলেন, 'সরকারের কাছে এটাই বলা যে আমাদের যদি কোনো কমসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে অনেক ভালো হয়, কারণ আমাদের বাচ্চাটা নিয়ে আমাদের সমাজে উঠার মত স্থান পাইতাম'।

ভিডিও দেখুন এখানে।  

news24bd.tv/TR