মসজিদের মুয়াজ্জিন-খাদেম প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) যা বলেছেন

মসজিদের মুয়াজ্জিন-খাদেম প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) যা বলেছেন

মুফতি মাহমুদ হাসান

মসজিদ আল্লাহর ঘর, ইসলামের কেন্দ্র এবং পৃথিবীর পবিত্রতম স্থান। আল্লাহ তাআলা একে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। পবিত্র কোরআনে মসজিদ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা শরিফ থেকে হিজরতকালে কুবা নামক জায়গায় পৌঁছেই সর্বপ্রথম সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।

অতঃপর মদিনা শরিফে পৌঁছেও তিনি প্রথম সুযোগেই মসজিদে নববী নির্মাণের ইচ্ছা পোষণ করেন। এমনকি সাহাবাদের সঙ্গে মসজিদ নির্মাণকাজে তিনি সশরীরে অংশ নেন। এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা যে সম্পর্কের ভিত্তিতে মর্যাদায় পার্থক্য হয়ে থাকে। কোনো কিছু স্বাভাবিকভাবে ছোট মনে হলেও তা আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে মহৎ ও প্রিয়তর হয়ে যায়।

তার মহিমা হয়ে ওঠে আকাশচুম্বী। বিষয়টি মসজিদের মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ। এসব ব্যক্তি সাধারণত কোরআনের হাফেজ, দ্বিনের আলেম এবং পরহেজগার হওয়ায় এমনিতেই সম্মানিত, কিন্তু মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ভিত্তিতে তাঁদের অবস্থান আরো উচ্চতরে পৌঁছে যায়।
মুয়াজ্জিনের মর্যাদা

আজান ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক।
এর গুরুত্ব ও মহত্ত্ব সর্বস্বীকৃত। আর আজানের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে মুয়াজ্জিনের মর্যাদাও অনেক উঁচু। মুয়াজ্জিনের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে অনেক বর্ণনা রয়েছে। নিম্নে সে বিষয়ে উল্লেখ করা হলো—
১. আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘জিন ও মানুষসহ যারাই মুয়াজ্জিনের আওয়াজ শোনে তারা সবাই কিয়ামতের দিন তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। ’ (বুখারি, হাদিস : ৬০৯)

২. আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি মানুষ আজান দেওয়া এবং প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর ফজিলত জানত, যদি লটারি ছাড়া কোনো বিকল্প না পেত, তবে অবশ্যই তাতে লটারি দিত।

তদ্রূপ যদি তারা জানত যে নামাজে আগে আসার কী ফজিলত, তাহলে অবশ্যই দৌড়ে আসত। তদ্রূপ যদি জানা থাকত যে এশা ও ফজরের জামাতের কী ফজিলত, অবশ্যই হামাগুড়ি দিয়ে হলেও জামাতে আসত। (বুখারি, হাদিস : ৬১৫)
৩. মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মুয়াজ্জিনদের মাথা সবার থেকে উঁচু থাকবে। ’ (মুসলিম, হাদিস : ৩৮৭)

৪. ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিন প্রকারের মানুষ কিয়ামতের দিন মেশকের টিলার ওপর থাকবে। যাদের মর্যাদা দেখে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবাই ঈর্ষান্বিত হবে। এক. সেই ইমাম, যার প্রতি মুক্তাদিরা সন্তুষ্ট; দ্বিতীয়ত সেই মুয়াজ্জিন, যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান দেয়; তৃতীয়ত, এমন দাস যে আল্লাহ ও তার মালিকের হক আদায় করে। ’ (মুসনাদে আহমদ : হাদিস ৪৭৯৯)

সারকথা, আজান দেওয়া কোনো ছোট কাজ নয়, বরং আল্লাহর কাছে এর মূল্য অনেক বেশি। কেননা মুয়াজ্জিন যেভাবে আজানের মাধ্যমে আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে এবং তাঁর একত্ববাদের গান গায়, ঠিক একইভাবে মহান আল্লাহও তাকে সেভাবেই পুরস্কৃত করবেন।

মসজিদের খাদেমদের মর্যাদা
মসজিদের খিদমত, পরিচ্ছন্নতা ও মসজিদ আবর্জনামুক্ত করা অনেক সওয়াবের কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন : ‘যে ব্যক্তি মসজিদ থেকে আবর্জনা সরিয়ে নেয়, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করেন। ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৭৫৭)

একজন হাবশি নারী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মসজিদের সেবা করতেন, মসজিদের আবর্জনা ও ধুলাবালি পরিষ্কার করতেন। কয়েক দিন তাকে দেখা যায়নি। রাসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, মহিলা কোথায়? আবু বকর (রা.) বললেন, মহিলাটি মারা গেছে এবং আমরা তাকে কবর দিয়েছি। তিনি বললেন, আমাকে মৃত্যু সংবাদ দিলে না কেন? সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, তখন গভীর রাত ছিল, তাই আপনাকে কষ্ট দেওয়া আমাদের পছন্দ হয়নি। তিনি বলেন, ​​ওই নারীর কবর কোথায়? সাহাবায়ে কিরাম কবর দেখালে রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই নারীর কবরে জানাজা আদায় করেন। (বুখারি, হাদিস : ১৩৩৭)

হাদিসটি থেকে প্রতীয়মান হয় যে মহানবী (সা.) মসজিদের খাদেমকে কতটা ভালোবাসতেন এবং এ সম্পর্কে কতটুকু গুরুত্ব দিতেন। তদ্রূপ সাহাবায়ে কিরামও মসজিদের খিদমতকে নিজেদের জন্য অনেক সৌভাগ্যময় মনে করতেন। খলিফা ওমর (রা.) একবার কুবা মসজিদে এসে নামাজ পড়লেন। অতঃপর একজনকে খেজুরের ডাল আনতে বললেন। খেজুরের ডাল আনা হলে তিনি তাতে কাপড় মুড়িয়ে ঝাড়ুর মতো বানিয়ে মসজিদ পরিষ্কার করলেন। (ফাতহুল বারি- ইবনে রজব ৩/৩৫৩)

বর্তমান সমাজের চিত্র
মসজিদের মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের এতটা মর্যাদা ও গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও প্রায়ই দেখা যায়, মসজিদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা তাঁদের প্রতিনিয়ত হেয়প্রতিপন্ন করছেন। তাঁদের অধিকার আদায়ে অবহেলা করছেন। এমনকি তাঁদের সম্মানও ক্ষুণ্ন্ন করা হচ্ছে। এটা অনেক দুঃখজনক। যখন একজন সাধারণ মুসলমানকে অবমাননা করা ও অবজ্ঞা করা জায়েজ নয়, তখন মহান দায়িত্ব পালনের কারণে সমাজে বিশিষ্ট অবস্থানে থাকা মসজিদের মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের অপমান করা কিভাবে বৈধ হতে পারে?

তাই পরিচালনা কমিটির কর্তব্য হলো নিজেদের সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে বিবেচনা না করে মসজিদের খাদেম মনে করা। মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের সঙ্গে সহানুভূতি, ভালোবাসা ও দয়ার আচরণ করা। তাঁদের সম্মানের প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখা।

লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা

এই রকম আরও টপিক

সম্পর্কিত খবর