তাপপ্রবাহের ফলে খরা, হুমকিতে চুয়াডাঙ্গার কৃষিখাত

তাপপ্রবাহের ফলে খরা, হুমকিতে চুয়াডাঙ্গার কৃষিখাত

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি

সাম্প্রতিক বছরগুলোর তীব্র তাপদাহের ফলে সৃষ্ট খরায় চুয়াডাঙ্গা জেলার কৃষি ও ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। বাড়তি খরচ, উৎপাদন ঘাটতিসহ চাষাবাদ উপযোগী পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় কয়েক বছর ধরেই ক্ষতির মুখে পড়ছেন কৃষকরা। এসব পরিস্থিতি মোকাবেলায় সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়ার দাবী তুলেছে কৃষক সংগঠনের নেতারা।

চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, চলতি বছর এপ্রিল মাসের শুরু থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলায় একটানা ৩৭ দিন তাপপ্রবাহ বয়ে যায়।

এরমধ্যে জেলার ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় চুয়াডাঙ্গায়। মার্চ মাসেও অন্তত ১১ দিন তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে রেকর্ড হয়। এ অবস্থা চলছে গত কয়েক বছর থেকে। এতে জেলাজুড়ে খরার প্রভাব দেখা দিয়েছে।

কৃষকরা বলছেন, গ্রীষ্ম মৌসুমে তাপপ্রবাহের ফলে চুয়াডাঙ্গা জেলার পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে বৃষ্টি পানির বিকল্প ভূগর্ভস্থ পানিও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে চাষাবাদে বাড়তি খরচ যোগ হচ্ছে। বিশেষ করে বোরো মৌসুমে ধান ও সবজি চাষে বাড়তি খরচের পাশাপাশি ফলন বিপর্যয় কৃষকদের দুর্ভোগে ফেলে দিচ্ছে।

দামুড়হুদা উপজেলার কৃষক আব্দুল মান্নান বলেন, এবছর তিনি সাত বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছেন। তীব্র তাপের কারণে সেচ ও ওষুধ কিনতে বিঘাপ্রতি বাড়তি ৬০০ টাকা খরচ হয়েছে। অন্যদিকে ধানের ফলন কমেছে বিঘার অন্তত সাত মণ। এতে তার কোনো রকমে উৎপাদন খরচ উঠে এসেছে। তীব্র তাপে ধানে চিটা হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একই অবস্থার বর্ণনা দেন চাষী এনামুল জোয়ার্দ্দার ও বাবু বিশ্বাস।

সদর উপজেলার আলোকদিয়া গ্রামের কৃষক লিটন হোসেন ও নাসির বিশ্বাস বলেন, এপ্রিল-মে মাসের তাপে তাদের গ্রীষ্মকালীন সবজি ও আমের ফলন কমে গিয়েছে। পাটের খেতেও একই অবস্থা। কয়েকদিন পর পাট জাগ দিতে হবে। মাঠে-ঘাটে কোথাও পানি নেই। এই দুশ্চিন্তায় এখন থেকেই তাদের দিন কাটছে।

কৃষকের এ অবস্থায় কৃষি বিভাগ অবশ্য ভিন্ন কথা বলছে। তাদের দাবী তাপদাহের ফলে বাড়তি সেচ খরচ হলেও ফলনে কোনো প্রভাব পড়েনি। চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এ বছর চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৩৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ২৯ হাজার ৬৮০ মেট্রিকটন ধানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

যার বিপরীতে ৩৫ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭৫২ মেট্রিকটন ধান উৎপাদন হয়েছে। অন্যদিকে ৪৯ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৪০ মেট্রিকটন ভুট্টার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যার বিপরীতে ৪৯ হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমিতে ৫ লাখ ৭৭ হাজার ৩৫৫ মেট্রিকটন ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে।

এছাড়া, ১৬ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে ৭ হাজার ৪৬০ মেট্রিকটন পাটের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর বিপরীতে ৪৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। যার অর্জন কিছুদিন পর জানা যাবে।

কৃষি বিভাগের হিসেবে সবজি চাষেও জেলার কৃষকরা অনেকাংশে সফল। সবজিতেও লক্ষ্যমাত্রার বেশি সবজি উৎপাদন হয়েছে। এবছর চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৩ হেক্টর ৪৩৯ জমিতে ৭৬ হাজার ৮৭৭ মেট্রিকটন ফুলকপি, ২ হাজার ৪০৫ হেক্টর জমিতে ৫৫ হাজার ৩১৫ মেট্রিকটন বাঁধাকপি ও ৮৩৯ হেক্টর জমিতে ২৬ হাজার ৮৪৮ মেট্রিকটন লাউ উৎপাদন হয়েছে।

এছাড়া বর্তমানে মাঠে থাকা আম ও পেয়ারাতেও বাড়তি ফলন হবে, দাবী কৃষি বিভাগের। তাদের মতে, এবছর চুয়াডাঙ্গায় ২ হেক্টর ৩০৪ জমিতে আম ও ১ হেক্টর ৮৭২ জমিতে পেয়ারা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।

সম্প্রতি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র। তাদের মতে চলতি বছর চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, চুয়াডাঙ্গা জেলায় কৃষিখাতে অন্তত ৩৬৩ কোটি টাকার ক্ষতি হতে পারে। এছাড়া তাপপ্রবাহের ফলে এ জেলায় জীবন-জীবিকায় অন্তত ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

এ অবস্থায় আগামীতে সঠিক সময়ে চাহিদা মতো চাষাবাদ কৃষকদের জন্য নতুন প্রতিকূলতার সৃষ্টি করবে বলে চুয়াডাঙ্গার কৃষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ মনে করছেন। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষক জোটের সভাপতি রবিউল হক বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলা বছরব্যাপী ফসল উৎপাদনের জেলা হিসেবে পরিচিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে চুয়াডাঙ্গা ও আশপাশের জেলাগুলোতে গ্রীষ্ম মৌসুমের চাষাবাদ ঝুঁকির মুখে পড়বে। তাপদাহে সৃষ্ট খরায় একদিকে কৃষকের খরচ বাড়ছে। অন্যদিকে ফলন কমে আসছে।

কৃষক নেতা রবিউল হক দাবী করেন, আগামীতে কৃষিক্ষেত্রে খরাসহিষ্ণু জাত নির্বাচন ও মাটির উপরিভাগের পানি ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষককে বাঁচাতে হবে। অন্যথায় মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে এ অঞ্চলের কৃষি।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, তাপপ্রবাহের কারণে চুয়াডাঙ্গার কৃষিতে বাড়তি সেচ খরচ লাগলেও উৎপাদন ঘাটতির আশংকা করছেন না তারা। তবে আগামীতে খরাসহিষ্ণু জাত নির্বাচনসহ সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তারা বরাবরই তথ্য প্রেরণ করছেন।

news24bd.tv/SC