বেগম মুজিব বলেছিলেন ‘সাত মার্চ তোমার মনে যা আসবে তাই বলবে’

সোহেল সানি ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব

জন্মদিনে অনিঃশেষ শ্রদ্ধা

বেগম মুজিব বলেছিলেন ‘সাত মার্চ তোমার মনে যা আসবে তাই বলবে’

সোহেল সানি 

৬ মার্চ ১৯৭১। অবিস্মরণীয় স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের ঐতিহাসিক সেই ঘোষণার মাহেন্দ্রক্ষণের আগের দিন। স্বাধীনতার পতাকা ও স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষনাকারী ছাত্রলীগের পক্ষে যুব ও ছাত্র নেতৃত্বের জোর দাবি ৭ মার্চই যেন জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ প্রশ্নে আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত।

নবীন নেতারা স্বাধীনতার ঘোষণা চাইলেও প্রবীন নেতারা মনে করছিলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা হবে চরম আত্মঘাতী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ করে বসবে জনসমাগম স্থলেই। ঙ্গবন্ধুই যাদের তিল তিল করে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত করেন, সেই শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন স্বাধীনতার ঘোষণা প্রশ্নে তখন একাট্টা। ইতিমধ্যে ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতেই ২ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে এবং ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষনা করে বসে।

পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা ও আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিও ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা প্রশ্নে মতানৈক্যে জড়িয়ে পড়েছেন।  

বঙ্গবন্ধুর হাইকমান্ড নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কেন্দ্রীয় পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এএইচএম কামরুজ্জামান, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ, পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ (পরবর্তী প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলে তাজউদ্দীনের নামটি দুই নম্বরে উঠে আসে) ও জাতীয় পরিষদ সদস্য ডঃ কামাল হোসেনও ৭ মার্চই স্বাধীনতার ঘোষণা প্রশ্নে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন।   অনেক নেতা ভাষণের পয়েন্ট লিখেও এনেছিলেন বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিতে।  

জাতীয় পরিষদ নেতা ও পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকলের কথা শুনলেও সুস্পষ্ট করে নিজের মত দেয়া থেকে ছিলেন বিরত। বঙ্গবন্ধু রমনার রেসকোর্স ময়দানের আহুত জনসমুদ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। শয়ন কক্ষে ডেকে একান্তে প্রিয়তমা সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা রেণুর মতামত জানতে চান। সহধর্মিণী  একবাক্যে বলেন,তোমার মন থেকে যা আসবে তাই বলবে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে নেতৃত্বের ওপর বেগম মুজিবের ছিলো ব্যাপক প্রভাব।  

১৯৬৮-১৯৬৯। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে পুরো পূর্বপাকিস্তান। দিকবিদিকশুন্য মানুষ। ছাত্রজনতার আন্দোলন তুঙ্গে। চারদিকে কানাঘুঁষা। ঠিক সেই মুহূর্তে চলছিলো শেখ মুজিবের প্যারোলে পিন্ডি যাওয়ার ছড়ানো ছিটানো কথাবার্তা। তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের গণঅভ্যুত্থান তখনো সংঘটিত হয়নি।  

কারামুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান প্রশ্নে নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত। ওই সময়ে বেগম মুজিব কারগারে গিয়ে দেখা করে স্বামী শেখ মুজিবকে বললেন, তোমার একদিকে আইয়ুব খান, অন্যদিকে সারাদেশের মানুষ, তাই তুমি যদি এখন প্যারোলে পিন্ডি যাওয়া স্থির করো, তাহলে আমি কিন্তু ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে আত্মঘাতী হবো। পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইউব খানের মসনদ তছনছ হয়ে গেলো। প্যারোলে নয়, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে   শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো আইউব খান। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯। ছাত্রজনতার পক্ষে তোফায়েল আহমেদ কর্তৃক "বঙ্গবন্ধু" উপাধিতে ভূষিত হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যাহোক স্বামী শেখ মুজিবের "বঙ্গবন্ধু" এবং পরবর্তীতে "জাতির পিতা" হয়ে ওঠার আগে একরকম বহু দূরদর্শিতার পরিচয় দেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

বেগম ফজিলাতুন্নেছা রেণুর ওই অসীম সাহসী উচ্চারণের প্রতি প্রিয়তম স্বামী শেখ মুজিবুর রহমানেরও ছিলো পরম সানুগ্রহ। সহধর্মিণীর সজ্ঞা স্থির চিন্তাভাবনার দ্বারা প্রভাবিতও হতেন বঙ্গবন্ধু।  

জগৎসংসারে নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেবার উদাহরণ খুবই বিরল। আর তা যদি হয়, স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতার জন্যে- স্বাধীনতার মহানায়কের জন্যে তাহলে তা তো অতি বিরল! সেই অতি বিরল মানুষটি বেগম ফজিলাতুন্নেছার আজ জন্মদিন।

বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো ৯৩ বছর। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জীবন বড় বিচিত্র, বড় ঘটনা বহুল। শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর বিয়ের গল্পটাও এক রূপকথার গল্প। মুজিবের বয়স তের। রেণুর বয়স মোটে তিন।  

প্রসঙ্গত, হযরত বায়েজিদ বোস্তামী পঞ্চদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে (ইসলামাবাদ)আসেন। সঙ্গীদলের অন্যতম ছিলেন দরবেশ শেখ মোহাম্মদ আউয়াল। বাগদাদের হাসানপুরে জন্মগ্রহণকারী শেখ আউয়াল বংশের অষ্টম পুরুষ হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ আউয়াল ঢাকার সোনারগাঁও এসে ঘাঁটি বাঁধেন। তিনি বিয়ে করে সোনারগাঁও বসবাস শুরু করেন। শেখ আউয়ালের পুত্র জহিরউদ্দিন কোলকাতায় স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। জহির উদ্দিনের পুত্র শেখ জান মাহমুদও কোলকাতা পাইকারি ব্যবসায়ী ছিলেন। শেখ জান উদ্দিন মাহমুদের পুত্র শেখ বোরহান উদ্দিন পূর্ববঙ্গে আসেন এবং এখানেই ব্যবসায় মনোযোগ দেন। এক পর্যায়ে টুঙ্গিপাড়ার কাজী পরিবারে বিয়ে করেন। শেখ বোরহান উদ্দিনের তিন পুত্র শেখ একরাম, শেখ তাজ এবং শেখ কুদরত উল্লাহ। কুদরত পিতার ন্যায় কাজী পরিবারেই বিয়ে করেন। তাঁর তিনপুত্র শেখ মজিদ, শেখ হামিদ ও শেখ রশিদ। শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা হলেন শেখ হামিদের পুত্র। আর শেখ মুজিবের মা হলেন শেখ মজিদের কন্যা। অর্থাৎ শেখ মুজিবের পিতা-মাতা হলেন আপন চাচাতো ভাইবোন। শেখ মুজিব এবং শেখ ফজিলাতুন্নেছাও আপন চাচাতো ভাইবোন।  

ঢাকা থেকে ৬০ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া। শেখ রশিদ ভাইয়ের পুত্র শেখ লুৎফরকে একদিন বললেন, তোমার বড় ছেলের সাথে আমার নাতনী ফজিলাতুন্নেছার বিবাহ দিতে হবে। কারণ আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাবো। রেণুর দাদা শেখ লুৎফর রহমানের চাচা। মুরব্বী বলে কথা! শেখ মুজিবের সঙ্গে রেণুর বিবাহ রেজিস্ট্রি হলো। রেণুর বয়স তখন তিন বছর। পাঁচ বছর বয়সে রেণু তাঁর মা হারান। ফলে সাত বছর বয়সে রেণুকে নিয়ে আসা হয় শেখ মুজিবের মা সায়েরা খাতুনের কাছে। কন্যাস্নেহে সায়রা খাতুন ফজিলাতুন্নেছাকে লালনপালন করেন। ১৯৪২ সালে শেখ মুজিব ও শেখ ফজিলাতুন্নেসার মধ্যে ফুলশয্যা হয়। যখন শেখ মুজিব রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছেন পুরোদমে। কলকাতা চলে যান এর পরপরই। পাঁচ বছরের মাথায় জীবনের এক মহামুহূর্ত হাজির হলো- ২৮ সেপ্টেম্বর -১৯৪৭। মুজিব-রেণু দম্পতির প্রথম সন্তান শেখ হাসিনা ভুমিষ্ঠ হলেন।

মানুষের বেদনা ভিন্ন নয়, কিন্তু বেদনার ঊর্ধ্বেও আছে মানুষের গৌরব। দেশবিভাগের ঘোরে তন্দ্রাবেশী শেখ মুজিব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন কলকাতায়। টেলিগ্রাম পেয়েও সন্তান হবার খবরে খুশি হলেও ছুটে আসতে পারেননি সুশীতল ছায়াচ্ছন্ন টুঙ্গীপাড়ার নিজ ভিটেমাটিতে। চেতনা, প্রতিজ্ঞা ও স্বপ্ন নিয়ে কাজ করবার দিন হয়ে উঠেছিল সেই সময়গুলো। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ ভেঙে গিয়েছিল বাংলা বিভাগে। তাই সঙ্কুচিত কণ্ঠ নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন শেখ মুজিব। "আমার নেতা" বলে সম্মোহিত করা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কলকাতার পাঠ চুকিয়ে ঢাকায় ঘাট বাঁধেন শেখ মুজিব। ভালোদিন পথের বাঁকেই অপেক্ষা করছে, যেন একটু এগিয়ে যেতে হবে। দ্রুত মুজিবীয় কণ্ঠের সাবলীল উচ্চারণ মানুষের মুখে মুখে, আড্ডায়-আলাপ ছাপিয়ে রাজনীতির মাঠে ময়দানের উপাদান হয়ে উঠলো। সেবক ও সহচরের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে অজেয় শক্তিতে পরিণত করলো। আর এ ক্ষেত্রে যিনি স্বামীকে পথ বাতলে দিলেন তিনি বেগম ফজিলাতুন্নেছা। মহান ভাষা আন্দোলনের বীর মহানায়ক শেখ মুজিব কারামুক্ত হলেন।  

 

১৯৫৩ সাল। স্বামীর কাছে চিঠিতে ঢাকায় আসার ইচ্ছাপোষণ করলেন। কিন্তু শশুর বাঁধ সাধলেন। রাগস্বরে বললেন, "রেণু, ওর নিজেরই কোন স্থিতি নেই এখন এ অবস্থায় তোমার যাওয়া ঠিক হবে না। " কিন্তু শেখ মুজিব নিজেই গিয়ে নিয়ে আসলেন পত্নীকে। উঠলেন ফুফাতো ভাই মমিনুল হক খোকার ঢাকার ৮/৩ রজনী বোস লেন, ঢাকার একটি ছোট্ট বাসায়। আওয়ামী লীগ গঠন ও তার যুগ্ম সম্পাদক হওয়ার পর শেখ মুজিবের ছোট্ট কক্ষেই নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের দেনদরবার হতো। এরই মধ্যে এলো যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী বিজয়। ১৯৫৪ সালের ১৪ মে সকাল দশটায় শেরেবাংলা ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণে শেখ মুজিবও মন্ত্রী হলেন। রাতে আদমজীতে সৃষ্টি করা হলো দাঙ্গা। শেখ মুজিব ওদিনই রজনী বোস লেনের বাসা ছেড়ে উঠলেন মিন্টোরোডের সরকারি বাসায়। কিন্তু দাঙ্গার পর ৯২-ক ধারা প্রয়োগ করে মন্ত্রিসভা বাতিল করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী শেরেবাংলাকে আখ্যায়িত করলেন পাকিস্তানের দুশমন হিসাবে। শেখ মুজিবকে বাসা ছেড়ে নাজিরা বাজারে গিয়ে উঠলেন (প্রয়াত ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফের বাসায়)। কিন্তু মুজিব পরিবার বেকায়দায় পড়ে গেলো। প্রবল বন্যায় নাজিরা বাজার ডুবে গেছে। ফলে তৎকালীন ঢাকা নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি হাফেজ মোহাম্মদ মুসার আরমানিটোলা বাড়িতে গিয়ে উঠতে হলো। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। পূর্ব পাকিস্তানে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারে। শুধু তাই নয় প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারেও আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিবুর রহমান শিল্প, বাণিজ্য ও দুর্নীতি দমন মন্ত্রী। এবার উঠলেন আব্দুল গণি রোডস্থ সরকারি বাসভবনে। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের আরেক বিশিষ্ট ভুমিকার কথা উল্লেখ করছি। তখনো পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে ওঠেনি। ১৯৫৬ সালেও বাংলা সিনেমা পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমদানি করা হতো। উত্তম-সূচিতা জুটি তখন তুমুল জনপ্রিয়। একদিন বেগম মুজিব তাঁর পতিকে বললেন, ভারতীয় ছবিগুলো দেখানো হচ্ছে বেশ ভালো, আমরা বিনোদনের সুযোগ পাচ্ছি।

 তবে আমাদের দেশেও তো প্রতিভা আছে। এ দেশেও তো গড়ে উঠতে পারে সিনেমা শিল্প, কেন হচ্ছে না? পত্নীর প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বললেন, "সিনেমা করার জন্য যে অবকাশ দরকার তা কোথায় এখানে? বঞ্চনা তো সর্বক্ষেত্রেই। পার্টিশনের আগে পশ্চিম পাকিস্তানী চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ছিলো বোম্বেতে। কিন্তু গত ৯ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে উঠেছে চলচ্চিত্র শিল্প। " কিছুূদিনের মধ্যেই শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি অর্থানুকূল্যে স্টুডিও গড়ার উদ্যোগ নিলেন। তাঁর নেতা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কদিনের ব্যবধানে "ফ্লিম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এফডিসি) নামে স্বায়ত্তশাসিত একটি সংস্থা গঠনের অনুমোদন আসলো কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে। সঙ্গে এক কোটি টাকার অনুদান। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এভাবেই বিভিন্ন ভুমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন।

শেখ মুজিবের সংগ্রামমুখর জীবন পরিবারের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্প্রীতির মায়াজাল ছিন্ন করলো। একজন ছিপেছিপে, দীর্ঘদেহী, ঘন ওল্টানো চুল মাথায়, খবরের কাগজ হাতে দাঁড়ানো শেখ মুজিব বক্তৃতায় বক্তৃতায় একদিন স্বপ্ন দেখলেন বাঙালি জাতির দেশ ও রাষ্ট্রস্বপ্নের কথা এবং সত্যিই তাঁর ডাকে তাঁর ছবিকে সামনে রেখে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটলো স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পেলাম লালসবুজের পতাকা।     

শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সম্পর্কে বলতে গেলে একটু ফিরে যেতে অতীতে। ১৯৫৩ সালে শেখ মুজিবের পরিবারের ঢাকায় আসা। কবি সুফিয়া কামাল যেদিন নারী শিক্ষা মন্দিরে (বর্তমান শেরে-বাংলা বালিকা বিদ্যালয়) শেখ হাসিনার হাতে শিক্ষার প্রদীপ জ্বলে দিয়েছিলেন, সেদিনও মেয়ের পাশে ছিলেন শুধু মা। বাবা শেখ মুজিব ছিলেন কারাগারে। আজকের যে প্রাণবন্ত একটি মানুষ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর কারিগর মা ফজিলাতুন্নেছা। যাঁর হাসিমাখা শ্যামলীময়া মুখখানিতে আমরা দেখতে পাই মায়েরই প্রতিচ্ছবি। আত্মপরিচয় এবং আত্মস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে শেখ হাসিনার সেবক হয়ে ওঠাও যেনো মায়ের আদর্শব্রত হয়ে পাওয়া এক পরম অর্জন।  

স্বামীর নিত্য সাহচর্যে ছিলেন না ফজিলাতুন্নেছা। কিন্তু রয়েছে তার ঘটনা পরস্পরা ও অশ্রুতপূর্ব  বিরল বিষাদময় কত জানি ঘটনা। সর্বংসহা, ধৈর্যের প্রতিমূর্তি, শতদুঃখ-কষ্টের মধ্যেও যাকে দেখা যায়নি এক মুহূর্তের তরে বিচলিত, সংগ্রামী স্বামীকে অহর্নিশ প্রেরণাদানকারী, মরণেও হয়েছেন যার সঙ্গী, সেই রমনী শেখ ফজিলাতুন্নেসার পরিবারের গল্পে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে আমাদের মানবিক চোখ।
   
বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন সদা হাস্যোচ্ছ্বল এক প্রাণময়ী নারী। পুরুষোত্তম স্বামীর সংগ্রামী আদর্শে উজ্জীবীত মহীয়সী নারী। মায়ের অসীম ধৈর্যই বুঝি শেখ হাসিনার জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাবার পুঁজি। আজ পিতার সোনারবাংলা গড়ার দৃপ্ত শপথ নেয়া চতুর্থবারের প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা যখন বিয়ের পিঁড়িতে, তখন পিতা শেখ মুজিব ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী। ১৯'৬৭ সালের কথা। ফজলুল হক হলের ভিপি এমএ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার বিয়ের বন্দোবস্তটা মূলত তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতারাই করেছিলেন বেগম মুজিবের পরামর্শে। আত্মীয়-পরিজনহীন বিয়ের আসরের নাটকীয় পরিবেশ হয়তো কোন দিন মুছে যাবার নয়। চট্টগ্রামে বিবাহোত্তর সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে যার মধুরেণ সমাপয়েৎ।  
 
'৬৭ সালে ইডেন কলেজ ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে ভিপি পদে মেয়ে শেখ হাসিনার জয়ের খবরটিও পৌঁছে দিয়েছিলেন কারাগারে অন্তরীণ স্বামীকে। আগরতলা ষষড়যন্ত্র মামলার পর একাত্তর। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর ছেড়ে ১৮ নম্বর রোডের বাসাতে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রহরায় অন্তরীণের দুঃসহ দিনগুলোর। ১ এপ্রিল থেকে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জামাতা এম এ ওয়াজেদ মিয়া শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেলকে নিয়ে খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ায় একটি বাসায় ওঠেন। ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই রাত আট টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডা. ওয়াদুদের তত্ত্বাবধানে জন্ম হলো জয়ের। পাশে ছিলেন লিলি ফুপু বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন এটিএম সৈয়দ হোসেনের স্ত্রী।

নানী ফজিলাতুন্নেসা মুজিব আদুরে নাম রাখেন স্বামীর সঙ্গে মিলিয়ে সজিব। শেখ হাসিনা তার সঙ্গে জুড়ে দেন তার স্বামীর নাম ওয়াজেদ। সেই সজীব ওয়াজেদ জয় ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। আর তার মা বাঙালির মুখে-অন্তরে "মানবতার মা"। যিনি নিজেকে পৌঁছে দিয়েছেন অনন্য এক উচ্চতায়, শেকড় থেকে শিখরে। ইতিহাসের এক অপূর্ব অধ্যায় , যাঁর শাসনামলে বিচার হয়েছে পিতৃহত্যা, মাতৃহত্যার,  ভাই-ভাবী হত্যার, চাচা-ফুফা হত্যার সর্বোপরি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড মামলার। বিচার হয়েছে এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করে ১৯৭১ এর পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছিলো, সেই নরঘাতক যুদ্ধাপরাধীদেরও। বঙ্গবন্ধু কন্যা কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনর্প্রবর্তন হয়েছে বাহাত্তরের সংবিধানের মূল মন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। গোটা বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে তাঁর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত  পদ্মাসেতু। শেখ হাসিনার জন্য ধন্য পিতা শেখ মুজিব, ধন্য মাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। এমন সুযোগ্য  সন্তানের মাতা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিনে জানাই অনিঃশেষ শ্রদ্ধা।  

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ।

news24bd.tv/আলী