আজ আমি আমার গত ২৪ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা শেয়ার করব। আমাদের ঠাঁই কোথায় সেটা জানার জন্য!
গতকাল ২৬/৪/২০ সকাল সাড়ে ৭টায় আমি ২৪ ঘণ্টার শিফট করার জন্য বাসা থেকে বের হই ওজিএসবি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে করে। সকাল সাড়ে ৯টায় একজন রোগী ভর্তি হন পূর্ব নির্ধারিত তারিখে সিজার করার জন্য। রোগীর বয়স ৩৭ এবং এটাই তার প্রথম বেবি। তাই অনেক মূল্যবান একটা প্রেগন্যান্সি ছিল।
সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে তার অপারেশন হয়। উনার মাতৃত্ব কালিন ডায়াবেটিস, হাপানি এবং জরায়ু তে প্রচুর (প্রচুর এ বলব) fibroid আগে থেকেই ছিল। যাই হোক, অপারেশন শেষ হলো। অপারেশনেরর আগে ওনার সব ভাইটালস ভালোই ছিল।
বিকেল থেকে লক্ষ্য করলাম o2 sat কমে যাচ্ছিল, ৯৪-৯৫%. তাই অক্সিজেন সাপোর্ট দিলাম। ইনহেলার, নেবুলাইজেশন ও দিলাম। একটু উন্নতি হয় কিন্তু আবার কমে যায়। রাত ৮ টার দিকে দেখছি ৯১-৯২%। আমি ভালোভাবে নড়েচড়ে বসলাম। এবার দিচ্ছি হাই ফ্লো অক্সিজেন। উহু! উন্নতি নেই। এর মধ্যে কনসালট্যান্ট কে জানালাম এই পরিস্থিতি। উনি বল্লেন ভয় পেওনা, ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু আমি ভয় পাবার মানুষ নই। সোহরাওয়ার্দী আর ঢাকা মেডিকেলেরর মতো টারশিয়ারি লেভেল এর হাসপাতালে এ গত ২০১৩ সাল থেকে কাজ করছি। খারাপ রোগীর চেহারা আমার একটু হলেও আন্দাজ আছে। ঢাকা মেডিকেল এ আমি নিজে খারাপ রোগির স্ট্রেচার টেনে রোগীকে ২ তলা থেকে ৪ তলায় ICU তে শিফট করেছি। তাই আমি অবশ্যই concern হলাম এবং রোগীর লোক কে আমি রেফার লাগতে পারে এই বলে এক্টু আন্দাজ ও দিলাম। পোস্ট অপারেটিভে সিস্টার কে বল্লাম laryngoscope r ET tube কোথায় আছে তা যেন বের করে রাখে। এক্টা এক্সট্রা ইনহেলার ও আনিয়ে রাখলাম। দুঃখজনক হলো আমার কনসাল্ট্যান্ট ফোনের ওপার থেকে আমাকে আশা দিতে চাইলেন রোগী ভালো হয়ে যাবে এই বলে।
রাত পোনে দশটা। ৮লিটার অক্সিজেন সহ তার এখন ৮৮-৮৯%. আমি বুঝে গেলাম আমার রেফার করা লাগবে। আমি কন্সাল্ট্যান্ট কে ইন্সিস্ট করলাম যে রেফার লাগবেই বেশি দেরি হবার আগে। কারণ রেফারাল লেটার লিখা, অ্যাম্বুলেন্স ডাকা, রোগী শিফট, কোথায় যাবে ম্যানেজ করা এগুলো ও সময়ের বেপার। রাত ১ টায় শিফট করলাম কাছেই আহসানিয়ার আইসিউ তে। ওনারা ভর্তি করলেন। এর পর শুরু হলো আসল কাহিনী।
ওনারা কিছুক্ষণ পরেই বল্লেন, শ্বাসকষ্টের রোগী ওনারা রাখবেন না। কুর্মিটোলা তে নেন। এরপর গেলো কুর্মিটোলা। ওনারা অ্যাম্বুলেন্স এই স্ক্যান করে বল্লেন, এটা করোনা রোগী না। ঢাকা মেডিকেলে নেন। ঢাকা মেডিকেল এ বলল মুগদা তে নেন। এটা এখানে রাখার রোগী না। সাথে খুব দুর্ব্যবহার! মুগদা বলল এই রোগী তো গাইনির। আমাদের এখানে না। এর মাঝে ঢাকা মেডিকেল এর ক্রিটিকাল কেয়ার এ কাজ করা ফ্রেন্ড কে ফোন দিলাম। সাহায্য করার চেস্টা করল। তারপর অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার বলল, আপা এখন কী করব? আমি বল্লাম, বাদ আছে সোহরাওয়ার্দী। ওখানে যান। আমি আমার এক বড় ভাই কে ফোন দিলাম যিনি ওখানকার করোনা ইস্যু নিয়ে ডাইরেক্টলি কাজ করছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, রোগী তো করোনা ডিটেকটেড না। ভর্তি কি নেবে না? ভাই বল্লেন, এখানেও হবে না। কারণ, নন কভিড হাস্পাতালে সাস্পেক্টেড কেস নিবে না। বল্লাম, তাহলে কী করা যায়? রোগীর তো সাপোর্ট লাগবে। বলল, পাঠিয়ে দেখ।
ড্রাইভার কে বললাম, যান সোহরাওয়ার্দী। রওনা দিল।
এর মাঝে আমি রোগীির খোঁজ নিচ্ছি। আমার কাছে থাকা অবস্থায় যাকে এক মুহূর্তের জন্য অক্সিজেন খুলতে দেইনি, সে কীভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে! তার শ্বাসকষ্ট টা আমাদের কে খুব অস্থির করছিল। অস্থিরতা টা বোঝাতে পারব না। শুধু ভাবছিলাম, একটু সাপোর্ট লাগবে, তাহলেই বোধয় বেঁচে যাবে!
সোহরাওয়ার্দীর গেট এই রোগী অক্সিজেন নেওয়া বন্ধ করল। ফেরত আসল আমার কাছেই। নিচে নেমে দাঁড়িয়ে আছি ডেথ ডিটেকশনের সরঞ্জাম নিয়ে। স্টেথ, বিপি মেসিন, লাইট।
রোগী আমার শ্বাস নেয় না, হৃদস্পন্দন নেই, পিউপিল ডাইলেটেড, ফিক্সড। সকাল ৬ টা। অবশেষে মৃত্যু ঘোষণা করলাম।
একজন ডাক্তার হয়ে এই কাজটি করা কতটা কঠিন, সেটা আমরাই জানি। আমরাও মানুষ। আমাদের ও মন খারাপ হয়। কিন্তু চোখে পানি আসা যাবে না। কারণ, আমরা যে ডাক্তার!
আমার প্রশ্ন, কোভিড হাসপাতাল কোভিড পজিটিভ ছাড়া নেবে না, নন কোভিড হাসপাতাল সাস্পেক্টেড কেস নেবে না, নন কোভিড হাসপাতাল কোভিড নেগেটিভ ছাড়া নেবে না।
তাহলে রোগীরা যাবে কোথায়? এভাবেই কি হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে অ্যাম্বুলেন্সে মারা যাবে??
বাস্তব চিত্র এটাই। এটাই হচ্ছে। কারণ কোনো সঠিক দিকনির্দেশনা নেই, নেই কোনো জবাবদিহিতা।
আজ সারদিন যেন আমি স্বাভাবিক হতে পারছি না। রোগীকে রিসিভ করলাম আমি, ডেথ সার্টিফিকেট ও দিলাম আমি। ব্যবধান ২১/২২ ঘণ্টা!
সঠিক দিকনির্দেশনা টা কি কোনোভাবে পাওয়া সম্ভব? একজন ডাক্তার হয়ে বড় নিরুপায় লাগল আজ নিজেকে!
লেখক- শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক
(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)