<p><strong>সাক্ষাৎকার&nbsp;</strong></p>

গণঅভ্যুত্থানের সাফল্য নস্যাৎ করে দেওয়া এদেশের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়: ফরহাদ মজহার

প্রশ্ন: সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার সমস্যা কি? সাংবিধানিক বা উকিলী প্রতিবিপ্লব কাকে বলে?

উত্তর:  সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে গণঅভ্যুত্থানের সাফল্য নস্যাৎ করে দেওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। এরশাদ বিরোধী গণঅভ্যুত্থান এবং তার পরের বাংলাদেশের রাজনীতি তার প্রমাণ। বিচার বিভাগ ধ্বংস , নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী না করে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন, পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘাড়ে চড়ে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েম, শেখ হাসিনাকে ভোটে জিতিয়ে এনে ইসলাম নির্মূল রাজনীতি শক্তিশালী করা এবং ফ্যাসিস্ট শক্তি মজবুত ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা দীর্ঘকাল কায়েম রাখবার পেছনে রয়েছে তথাকথিত ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ নামক গণতন্ত্র ও গণবিরোধী উকিলি ধারণা। অতএব সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব হচ্ছে আইন, সংবিধান বা ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’-র নামে একটি শক্তিশালী গণঅভ্যূত্থানের পরেও জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি হিশাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেওয়া। যেহেতু এই ক্ষেত্রে আইন ও সংবিধানকে অজুহাত হিশাবে খাড়া করা হয়, তাই একে 'সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব' বলা যায়।   সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের সদ্য গড়ে ওঠা গাঠনিক শক্তি (Constituting Power) আইনের নামে এবং সংবিধানের ধোঁকাবাজি দিয়ে পরাজিত করা এবং প্রতিবিপ্লব সফল করে বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট সংবিধান ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বহাল রাখা। শক্তিশালী গণঅভ্যূত্থান ঘটে যাবার পরেও বাংলাদেশে জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠন আইনের দোহাই দিয়ে প্রতিহত করাই 'সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা' নামক আইনী মতাদর্শের কাজ। অর্থাৎ গণঅভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করে দেবার জন্যই আইন, সংবিধান বা ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’-র কেচ্ছা হাজির করা হয়।   অথচ মানবেতিহাস, রাজনীতি এবং উচ্চতর আইনী সাহিত্যে এই সত্য একালে পরিষ্কার ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে জনগণই সার্বভৌম এবং পুরানা কলোনিয়াল ও ফ্যাসিস্ট সংবিধান ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা বাতিল করে নিজেদের জন্য নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম জনগণের অবিচ্ছেদ্য অধিকার। দুনিয়ার কোন আইন বা সংবিধান জনগণের এই অধিকার হরণ করতে পারে না। অথচ বাংলাদেশের উপদেষ্টা সরকার জনগণের এই অধিকার হরণ করলো। অতএব সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব রুখে দেওয়া ছাড়া বাংলাদেশে গণতন্ত্র – অর্থাৎ জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে নতুন বাংলাদেশ গড়া যাবে না।   বাংলাদেশে এতো বড় গণ অভ্যূত্থান ঘটে যাবার পর এখন যা কিছু করবার সেটা নাকি করবে উকিল ও আদালত এবং সেটা করবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার তৈরি ফ্যাসিস্ট সংবিধান মেনে। ফ্যাসিস্ট সংবিধানের আলোকে এবং তার অধীনেই নাকি রাষ্ট্র, সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কার চলবে। যেহেতু সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের উদ্দেশ্য আইন ও সংবিধানকে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের উর্ধে সমুন্নত রাখা এবং জনগণের গাঠনিক শক্তিকে ফ্যাসিস্ট আইন ও সংবিধান দিয়ে নস্যাত করা -- তাই ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নিযুক্ত ফ্যাসিস্ট প্রেসিডেন্টের হাতেই গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শপথ নিয়েছেন। যা আইন কিম্বা রাজনীতি কোন দিক থেকেই সিদ্ধ বা বৈধ হতে পারে না। এটা লজ্জার বিষয় যে ফ্যাসিস্ট প্রেসিডেন্টের ‘উপদেষ্টা’ হিশাবে উপদেষ্টাগণ কাজে নিয়োজিত হয়েছে।   বাংলাদেশে সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের এই বিপজ্জনক বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। একে মোকাবিলা করতে হলে জনগণকে অবশ্যই আইন ও জনগণের অভিপ্রায়ের সম্বন্ধ বুঝতে হবে। জনগণ যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে গণঅভ্যুত্থানে্র মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট শাসককে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারে, তাহলে সেই গাঠনিক শক্তি (Constituent Power) দ্বারা পূর্ণ বিজয়ের শীর্ষে পৌঁছাতেও সক্ষম। পূর্ণ বিজয়ের জন্য সংবিধানসহ পুরা ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা উৎখাত এবং নিজেদের জন্য নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নই জনগণের প্রধান এবং একমাত্র কর্তব্য হিশাবে হাজির হয়েছিল। কিন্তু তাকে সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের দ্বারা নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে।   গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণ যখন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের গাঠনিক শক্তি (Constituent Power) হিশাবে হাজির হয়, ঠিক তখনই জনগণের বিরুদ্ধে সমাজের শক্তিশালী শ্রেণী ও গোষ্ঠি পালটা প্রতিবিপ্লব ঘটাবার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার কোন ব্যতিক্রম হয় নি। বিপজ্জনক দিক হোল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা সফল হয়েছে।   প্রশ্ন: প্রতিবিপ্লব ঘটাবার জন্য সাংবিধানিক বা উকিলী বুদ্ধি প্রয়োগের প্রধান হাতিয়ার বা নিদর্শন কি?

উত্তর: সাধারণত এটা করা হয় ‘সাংবিধানিক শূন্যতা’র দোহাই দিয়ে। 'সাংবিধানিক শূন্যতা'র দাবি ভূয়া দাবি। যদি সাংবিধানি শূন্যতার দ্বারা দেশ বা রাষ্ট্র না চলে তাহলে তাহলে সামরিক অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে সংবিধান স্থগিত বা বাতিল করে দিয়ে সামরিক ফরমান দিয়ে রাষ্ট্র কিভাবে চলে? আসলে রাষ্ট্রের 'সাংবিধানিক শূন্যতা'-র দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রের জরুরি প্রয়োজনে পুরানা ফ্যাসিস্ট সংবিধান বহাল রাখাটাই প্রধান যুক্তি হিশাবে হাজির করা হয়। এটা ভূয়া যুক্তি। কারন নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন অবধি গণঅভ্যুত্থানের সরকারের আদেশে রাষ্ট্র অনায়াসেই চলতে পারে, সামরিক অভ্যূত্থানের ক্ষেত্রে যেটা চলতে পারে।   সামরিক অভ্যূত্থানের ক্ষেত্রে সামরিক ফরমান দিয়ে দেশ চলতে পারলে গণ অভ্যুত্থানের সরকারের আদেশে দেশ চলতে পারবে না কেন? 

প্রশ্নঃ সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের পর বাংলাদেশে এখন কি হচ্ছে?

উত্তর: ফ্যাসিস্ট শক্তির পুরানা আওয়ামিপন্থি দালালদের ব্যবহার করে ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া ভূয়া সংবিধান সংস্কার কমিশন জাতীয় হযবরল গঠন করে সংবিধান ও রাষ্ট্রের অন্যনায় সংবিধানের কিছু বাহ্যিক সংস্কার করবার কথা বলা হচ্ছে। লক্ষ্যণীয় যে পুরা প্রক্রিয়া থেকে জনগণকে সম্পূর্ণ দূরে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ জনগণ তাদের যে অভিপ্রায় বাস্তবায়নের জন্য এতো আত্মত্যাগ করল তাকে উকিলি চাতুরি দিয়ে আড়াল এবং একসময় সম্পূর্ণ মুছে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয় রাষ্ট্র ঠনের ক্ষেত্রে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের সম্ভাবনা শুধু নস্যাৎ করে দেওয়া হয় নি, এমনকি সংস্কারের ক্ষেত্রেও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণকে বাদ দেওয়া হোল। সংস্কার করবে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া বিভিন্ন কমিশন, জনগণ নয়। জনগণ নিজেদের জন্য নিজেরা একটি নতুন রাষ্ট্র প্রণয়ণের যে গাঠনিক শক্তি চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছিল সেই শক্তিকে এই ধরণের প্রতিক্রিয়ার শক্তি দ্বারা নস্যাৎ করে দেওয়া হচ্ছে। ইতিহাসে এরকম নজির বিরল। ক্রমে জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যাক্তির আর কোন ছিঁটেফোটা অবশিষ্ট থাকবে না। রাষ্ট্র যেমন ছিল ঠিক তেমনই আবার ফ্যাসিস্ট রূপ ও শক্তি নিয়ে হাজির থাকবে। এবার হাজির থাকবে আগের চেয়েও আরও দ্বিগুন শক্তিশালী হয়ে। কারণ সমাজের শক্তিশালী গণবিরোধী শ্রেণী এই ধরণের ঘটনা থেকে শেখে এবং জনগণকে নিয়ন্ত্রণ ও শাসনের নতুন হাতিয়ার বা পদ্ধতি আবিষ্কার করে।  

প্রশ্ন: এখন কি হবে? 

উত্তর: বাংলাদেশে জনগণের বিপুল আত্মত্যাগের পরও জনগণকে যেভাবে সংবিধান ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে নতুন ভাবে নিজেদের রাষ্ট্র গড়তে দেওয়া হোল না তা বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি কলংকজনক অধ্যায় হিশাবে লিখিত থাকবে। সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব দাবি করে যে জনগণ নিজেদের জন্য নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন, নিজেদের জন্য নতুন রাষ্ট্র গঠন – অর্থাৎ পুরাতন রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত করে নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার অধিকারী নয়। তাই প্রতিবিপ্লবীদের দাবি, গণঅভ্যূত্থানের পরও জনগণকে পুরানা সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে, সবসময়ই ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া আইন ও ব্যবস্থা কিম্বা ঔপনিবেশিক সংবিধানের ধারাবাহিকতা, বিধানাদি এবং কাঠামো মেনে নিতে হবে, ইত্যাদি।   এই কারণেই অর্থাৎ সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে বাংলাদেশ এখনও ব্রিটিশ ঔপবেশিক শক্তির ঔপনিবেশিক আইন ও রাষ্ট্র কাঠামো বহাল রয়েছে। পুরানা ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাই নাকি আমাদের বাহ্যিক কিছু সংস্কার ছাড়া মেনে নিতে হবে। অর্থাৎ বিপুল আত্মত্যাগের পরও জনগণ কিভাবে বাংলাদেশকে ‘গঠন’ করবে তার কোন অধিকার জনগণের রইল না।   এখন এলিট ও ক্ষমতাসীন শ্রেণী তাদের ওপরতলার কিছু পুরানা ও পরিচিত ব্যক্তিদের দিয়ে ‘কমিশন’ বানিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলবে। এই সকল সংস্কারে জনগণ নয়, সমাজের এলিট ও ওপরতলার শ্রেণী ও গোষ্ঠির আধিপত্য থাকবে। জনগণ আগের মতোই এতিম হয়ে উপরের দিকে চেয়ে থাকবে।   কেউ এখন কি করা উচিত ছিল সেই প্রশ্ন তুলবেন না। এ ব্যাপারে আমি বারবারই সাবধান করেছি, উপায় বাতলে দিয়েছি। এখন সমাজের এলিট শ্রেণী ও গোষ্ঠির ‘কমিশন’ এনজয় করুন। একটি ফাঁস হওয়া ফোনালাপে শুনলাম শেখ হাসিনা বাংলাদেশের কাছাকাছি আছেন, তিনি চট করে একদিন হাজির হয়ে যাবেন বলে হুমকি দিচ্ছেন। আমাদের নিজেদের ভিত শক্ত করা ছাড়া আর কোন কাজ থাকতে পারে না। এখন কি করবেন সেটা আপনাদের ইচ্ছা।

ফরহাদ মাজহার বাংলাদেশের একজন বুদ্ধিজীবী , কবি ও নয়া কৃষি , ভাব আন্দোলনের পুরোধা 

news24bd.tv/ডিডি