<p><strong>কবিতা</strong></p>

জান্নাতি কবিতার একগুচ্ছ কবিতা

পাশার গুটি

আমি বোকা বলে ঠকে যাই বারবার। ঠকায় তোমাদের ঈশ্বর। কলেজের প্রথম দিনগুলোতে প্রায়ই আমার চোখে ডুবে যেত অরিত্র'র চোখ; ক্যাম্পাসের বাইরে প্রথম যেদিন অরিত্রের সাথে দেখা করতে যাই আমার বুক দুরু দুরু! তুলি, আমার প্রাণের বন্ধু তুলি চললো সাথে। তারপর শহরের অলিগলি নদীর ধার পার্কের বেঞ্চে অরিত্র, আমি আর তুলি কতো হাসি-গল্প-গানে মেতেছি, আর ডুবেছি অরিত্রের চোখে! তারপর কবে একদিন আমাকে ডিঙিয়ে অরিত্র'র চোখ ডুবে গেলো তুলির চোখে? সবাই বললো, তুই কী বোকারে! তুলি আর অরিত্রের বিয়েতে গেছি দামি উপহার নিয়ে, ফিরেছি যমজ পকেট ভরা কষ্ট নিয়ে। এবারও বন্ধুরা বললো, বিয়েতে এলি? তুই কী ভীষণ বোকা! তারপর অনেকটা পথ, আমার রুক্ষ ভুবন সবুজ হয়ে উঠলো। আত্মীয়-স্বজন বলতে লাগলো, দেখো, বোকা মেয়েটা কতো ভালো বর পেলো! আমার বুকে তখন স্বর্ণচাঁপার ঘ্রাণ! চাঁদের মতো পুত্র, পরিপাটি সোনার জীবন। এক দুপুরে বীণাদি এলো সাদা বসনে। বরের ছেলেবেলার বন্ধু; বীণাদির বুকে তখন গোরস্থানের কান্না, বাড়ির লোকেদের সুস্পষ্ট অবহেলার ক্ষত। আমরা তাকে সঙ্গ দিই, সাহস দিই। মাতিয়ে রাখতে চাই গল্পে-আড্ডায়। বীণাদি প্রায়ই  আসে, এক বিকেলে বাইরে থেকে ফিরে দেখি, বীণাদি আমারই বিছানায়...। অলক্ষ্যে সরে এসে নিজেকে বলি, তুই এতো বোকা কেন! বোকা পেয়ে তোকেই বারবার পাশার ঘুটি বানায় চতুর ঈশ্বর।  

চুমু

চৈত্রের খরার মতো পুড়তে পুড়তে হাত বাড়াই বেডসাইডের জলের গ্লাসে, একটানে চো চো করে টেনে নিতেই জ্বরো জিভে ছড়িয়ে পড়ে নিমপাতা স্বাদ! আড়ষ্ট চোখে দাহ, ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম স্বপ্ন আর বিভ্রমে মাখামাখি। প্যারাসিটামলের প্রেমে শরীর জুড়ে ইলশেগুঁড়ি, শীতল জলের কুয়োয় ভিজতে ভিজতে চোখ মেলি। কেমন লাগছে এখন? কিছু খাবে? খাবারের কথায় বিবমিষা জাগে ! তোমার ঝুঁকে পড়া চোখে অস্পষ্ট তাকিয়ে বলি, খাবো। কী খাবে, বলো? চুমু খাব। তোমার একটা চুমুই কেবল আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারে জীবনের স্বাদ।  

লড়াই

মানুষেরা কেমন ভেঙে ভেঙে ধসে পড়ে, সান্ধ্য রোদে ওড়ে পিপীলিকা বসন্তের উত্তাপে মৃত্যুর  ঘ্রাণ। মানুষের ঢেউ বাঁধা শহরে বেগানা হাঁটি আমি। দু'চোখে সূর্যাস্তের ছায়া নিয়ে ফুটপাতে বসে থাকে ছিন্নবাস দেবশিশু। নিয়ন আলোর ঘোমটায় ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকে চাঁদ। সুখ নিখোঁজ, স্বপ্নরা বধ্যভূমির পথে। বুকের মধ্যে কে ফিসফিসিয়ে বলে, 'সুখ খোঁজো? তার আগে শিখে নাও লড়াইয়ের আদিপাঠ'।

ঈশ্বরের ঘুম

ভোরের আকাশ থেকে লাল আগুন নেমে আসার আগ পর্যন্ত ঈশ্বর ঘুমিয়ে থাকেন। রাতের অন্ধকারে দাউদাউ জ্বলতে থাকে মানচিত্র, আততায়ী শিশুদের শরীর ছিন্নভিন্ন করে মায়ের হৃদপিণ্ড থেকে টেনে ছিঁড়ে নেয় সন্তানের কোমল প্রাণ! আমাদের আচমকা হল্লায় ঈশ্বরের ঘুম ভেঙে যায়, তিনি বিরক্ত হন অভিশম্পাত বর্ষণ করেন। আমরা ভীত হয়ে হিসেব করতে বসি, কোন দেশের শিশুরা এতিম হচ্ছে? কোন ধর্মের মানুষ মরছে? তারা হিন্দু মুসলিম ইহুদি নাকি খ্রিস্টান? তারপর গুটিগুটি পায়ে সবাই ঘরে ফিরে যাই। ঈশ্বরের ঘুম ভাঙানোর অভিশাপে ওরা মরতেই থাকে।

পিরীতি

কইবার পারি না, বুকের মইদ্যে কী গহীন দইরার ঢেউ, ধোঁয়া নাই আগুন নাই তবু পোড়ায় কেউ!

এই যে মাটি খরায় যেমন ফাইট্যা চুরচুর, ঝড় নাই জল নাই তবু ভাসায় কূল।

আলিঙ্গনে নকশিকাঁথা শীতল পাটির সুখ, জলে ভাসা শাপলা শালুক বুক করে ধুকপুক।

বুকের মইদ্যে তাহার আসন যেন শাঁখের করাত। তারে ছাড়া জোছনা রাতেও বুকের মইদ্যে উপুড় কালির দোয়াত।

ক্যান দেয় মানুষ এই যাতনার বিষ পেয়ালায় চুমুক? এক লহমার সুখের আশায় কলঙ্ক বয়, কান্দে যুগযুগ।

দুঃখবতী

একটা মেয়ে যাচ্ছে হেঁটে, খোলা চুলে তারার মতো দুঃখগুলো জড়িয়ে  আছে। চকচকে চোখ, ঠোঁটের কোণে ভ্রুর টানে দীঘির জলে শিশির হয়ে কান্নাগুলো মিশে আছে। একটা মেয়ে আনমনা মন চায়ের কাপে দিচ্ছে চুমুক, জোছনা মেখে দুঃখগুলো হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ছে উড়ুক। দৃষ্টিতে ঢেউ হাসছে সে খুব। আসলে সে পুরোনো কোনো দুঃখ ছুঁয়ে  মুক্তো পাবার আশায় আশায়, বুকের ঘরে পুষছে ঝিনুক। গুনগুনিয়ে সুর ভাজছে খোঁপার ভাঁজে ফুল গুঁজছে হাসির ঢেউয়ে পাড় ভাঙছে। বছর কুড়ি আগের কথা, আসলে সে ভালোবেসে অনেক আগেই খুন হয়েছে।

কবি পরিচিতি: জন্ম ৭ মে'। শেকড় সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর। বাবার চাকরি সূত্রে জন্ম ও বেড়ে ওঠা বগুড়ায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। কাজ করেছেন বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থায়। গ্রুপ থিয়েটারের সাথে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে গৃহিণী।  

news24bd.tv/ডিডি