মানুষের ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয় কেন

৭১২ খ্রিস্টাব্দে স্পেন ও সিন্ধু বিজয়ে ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমানদের রাজকীয় উত্থান হয় তারুণ্যের পথ বেয়ে। স্পেনে মুসলিম শাসনের গৌরবগাথার সূচনা করেন সেনাপতি জিয়াদ আল তারিক। সিন্ধু জয়ের মহানায়ক সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাশেম। তাঁরা দুজন ছিলেন টগবগে যুবক, বয়স ১৮ কি ২০-এর মধ্যে বা কমবেশি।

কালের স্রোতে হারিয়েছে স্পেনের প্রায় ৮০০ বছরের মুসলিম শাসন। সিরাজউদ্দৌলার পতনে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় ১৭৫৬ সালে। অথচ ১৭ জন অশ্বারোহীর তাড়া খেয়ে দুপুরের রান্না করা খাবার ফেলে লক্ষ্মণ সেন পালিয়ে ছিলেন ১২০৪ সালে। বাংলা ও বাঙালির ৮২০ বছরের ইতিহাস ভাঙল ২০২৪!

আইয়ুব খান ইস্কান্দর মির্জাকে হাওয়াই জাহাজে উঠিয়ে পাকাপোক্ত করেছিলেন নিজের মসনদ। মহান রেজাশাহ পাহলবি ইরানি বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে নিজেই বিমান চালিয়ে দেশ ছাড়েন! এখানেই কাজী নজরুল ইসলামের উচ্চারণ— ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়

আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়। ’

‘ওয়াতু ইঝঝুমান তাশাউ ওয়া তুজিল্লুমান তাশাউ...’ আয়াতের পুরো অংশ ঐতিহাসিক খন্দকের যুদ্ধের পটভূমিতে ৬২৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে অবতীর্ণ হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে রাসুল) আপনি বলুন, হে আল্লাহ তুমিই মালিক সার্বভৌম শক্তির। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্যদান করো এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য কেড়ে নাও...সমুদয় কল্যাণ তোমারই হাতে। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ২৬)

ক্ষমতার মোহ, অর্থের লোভ ও পশুত্বের সুখের অন্যতম বৈশিষ্ট্য অহংকার। সামান্য সাফল্য, একটু বাড়তি প্রাপ্তি মানুষকে অনেক সময় অহংকারী করে ফেলে। কিন্তু মহান আল্লাহর নির্দেশ—‘অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কোরো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ কোরো না, কারণ আল্লাহ কোনো উদ্ধত অহংকারীকে ভালোবাসেন না। ’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৮)

ইতিহাসের শিক্ষা হলো : ‘ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ’ কখনো কখনো ক্ষমতা-দুর্নীতি, সমার্থক ও সমান্তরাল হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস ও দর্শনবিদ ব্রিটিশ ব্যক্তিত্ব লর্ড অ্যাকটনের বক্তব্য : ‘সব ক্ষমতাই দুর্নীতি এবং চূড়ান্ত ক্ষমতা, চরম দুর্নীতিগ্রস্ত করে। ’

একজন শাসক যখন ক্ষমতার মোহ ও দাপটে নিজের প্রতি অধিক আস্থাশীল হয়ে ওঠেন, তখন শুরু হয় তার পতনযাত্রা। জনতার রুদ্ররোষে কেঁপে ওঠে তার ‘তখতে তাউস’! তখন শুধু পদত্যাগ নয়, দেশত্যাগ ও কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়! পতনের পর পথ থাকে না পালাবারও, থাকে না ঠিকানা, দিতে চায় না কেউ আশ্রয় ও নিরাপত্তা!

রুমানিয়ার চসেস্কু, ফিলিপাইনের মার্কোস অথবা সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি, রাজাপক্ষেসহ পৃথিবীর অসংখ্য পতিত শাসকের শেষ অধ্যায় ছিল দারুণ নিঃসঙ্গ ও নির্মম। অত্যাচারী ফেরাউনের পতন, পরাজয় এবং মুসা (আ.)-এর নেতৃত্বে দুর্বল ও সাধারণ জনগোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়া প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর ঘোষণা—

‘সেই দেশে যাদের সে দুর্বল রাখে

তাদের প্রতি মোর অনুগ্রহ থাকে।

তাদের—আমি সেথা নেতা বানাইয়া

সে দেশের অধিকারী দিই করিয়া। ’

(সুরা : কাসাস, আয়াত : ৫)

তিনি বলেন, ‘যদি আল্লাহ লোকদের একজনের সাহায্যে অন্যজনকে প্রতিহত না করতে থাকতেন তাহলে দুনিয়ায় বিপর্যয় তৈরি হতো। কিন্তু আল্লাহ সৃষ্টিজগতের প্রতি কতই না অনুগ্রহশীল!’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৫১)

ক্ষমতার দুরন্ত জিহ্বা শান্তির পৃথিবীতে অশান্তির জ্বলন্ত শিখায় ফুঁ দিলে মায়াময় ধরিত্রী হয় মানুষের শোণিতধারা স্নাত। স্বৈরশাসকরা নিরাপত্তা কৌশল ও ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগীদের মিথ্যা আশ্বাসে অতি আস্থাশীল হয়ে ওঠেন, যদিও বেলাশেষে সব কিছুই বিফল। তিন লাখ শ্রমিকের ৩০০ বছরের অর্থহীন অমূল্য শ্রম-ঘামে মহাচীনের মহাপ্রাচীর (গ্রেটওয়াল) নির্মাণকালে দুর্ঘটনায় প্রাণ দেয় লক্ষাধিক শ্রমিক! নির্মাণকারী সম্রাটদের বিশ্বাস ছিল মহাপ্রাচীর কেউ অতিক্রম করতে পারবে না। অথচ তা যুগে যুগে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই বেরহম সময়ে চার তারকা জেনারেলরা যদি নিরাপত্তাব্যূহ হয়ে না দাঁড়ান; তাতে বিস্ময়ের কী!

‘এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা। সকালবেলা আমির, রে ভাই (ও ভাই) ফকির, সন্ধ্যাবেলা...। ’ —কাজী নজরুল ইসলাম

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর