না দেখেই টাকা চিনতে পারে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী লোকমান

দুই চোখের আলো নিভে গেলেও কাগজের নোট হাতে নিলেই বলে দিতে পারে তা কত টাকার নোট। বিশেষ এই গুণ রয়েছে ১৭ বছর বয়সী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী লোকমান হোসেন।

টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের বহুরিয়া গ্রামে জন্ম তার। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া লোকমান শওকত আলী ও লিলি বেগম দম্পতির দ্বিতীয় ছেলে।

চোখে দেখতে পান না কিছুই তবুও দিব্যি সাইকেল চালাচ্ছেন লোকমান হোসেন। চোখে না দেখলেও মানুষ চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল করে না দৃষ্টি প্রতিবন্ধী লোকমান।

লোকমান বলেন, আমি হাঁটতে পারি। তারপর রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালাতে পারি।  

শুধু সাইকেল চালানো নয়, লাঠি ছাড়াই এলাকায় ঘুরে বেড়ান লোকমান। পায়ে হেঁটে মসজিদে গিয়ে আদায় করেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। এর মাঝে শুনে শুনে মুখস্থ করেছেন আড়াই পারা কুরআন।

গ্রামের আঁকাবাঁকা সড়কে লাঠি ছাড়া চলাচল করতে দেখা যায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী লোকমানকে। হাঁটতে হাঁটতে বলে দিতে পারেন এলাকায় কোথায় কার বাড়ি। বলেন, 'আইডিয়া আছে যে অমুক বাড়ি ওমুকখানে হইতে পারে'।

আজানের সময় হলেই লোকমান ছুটে যায় মসজিদে, সেরে নেন অজু। মসজিদ থেকে বেশিরভাগ সময় তার কণ্ঠে ভেসে আসে সুমধুর আজান।

বর্ষায় ভেলা নিয়ে খেলা করার সময় পানিতে ডুবে মারা যায় লোকমানের বড় বোন ও ছোট ভাই। সুখের পরিবারে নেমে আসে শোকের মাতম।

তার মা বলেন, তিনটা আমার বাচ্চা হয়েছিল প্রথম মেয়ে ছিল। তারপরে এক ছেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী তারপরে এক ছেলে ছিল শুভ। হঠাৎ করে বন্যা হইল। বন্যার পরে কলা গাছের ভেলাতে খেলার সময় বড় মেয়ে ও ছোট ছেলে মারা গেছে।

জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় লোকমানকে ছেলে হিসাবে মেনে নিতে নারাজ ছিলেন বাবা শওকত আলী। দুই সন্তান মারা যাবার পর স্ত্রী লিলি বেগমের হাত ছেড়ে অন্যত্র সংসার বাঁধে শওকত।

লোকমানের মা বলেন, 'একটি মাত্র দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছেলে আছে। ওই ছেলে থাকার কারণে ওর আব্বা তার ভবিষ্যতের জন্য চলে গেছে যে এই ছেলে তো কামাই করে খাওয়াতে পারবে না। এ কারণে অন্য জায়গায় যেয়ে বিয়ে করেছে। ' 

এদিকে প্রতিবন্ধী ছেলেকে বুক থেকে ফেলতে পারেনি মা লিলি বেগম। খেয়ে না খেয়ে একমাত্র সন্তান নিয়ে মানবেতর দিন পার করছেন এই নারী।  

তিনি বলেন, 'আমি তো তারে রেখে যাইতে পারি না। অনেক মেয়ে আছে যায়। আমি চাইছি ওরে যেন মানুষ করে যাইতে পারি। যাতে বলতে না পারে বাপে রেখে গেছে দেখে মা আমাকে রেখে গেছে গা। ' 

তিনি আরও বলেন, 'অনেক সময় ভালো মতো খাওয়াতে পারি না। অনেকে খায় তখন নিজের মনে কষ্ট লাগে। কষ্ট লাগলেই কি করমু আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। আল্লাহর উপর তো আর হাত নাই। ' 

স্কুলের বেঞ্চে লোকমানের জায়গা না হওয়ায় ভর্তি হন স্থানীয় এক হেফজ্ মাদ্রাসায়। মাদ্রাসার এক হজুরের তিলাওয়াত শুনে মুখস্থ করেছে দেড় পারা কুরআন। স্থানীয়দের সাহায্য সহযোগিতায় কোনো মতে খেয়ে পড়ে ছেলে নিয়ে দিন পার করছে এই নারী।

এলাকার একজন বলেন, 'আমার বাসায় মাদ্রাসা আছে- ওখানে ১ বছর যাবত পড়ে। এখানেও আবার পড়তেছে আজান দিতে পারে কোরআন শরফি পড়া মুখস্ত আছে। ' 

আরেকজন বলেন, 'খাইয়াও দিন যায় না খাইয়াও দিন যায়। জায়গা নাই, জমি নাই, কিচ্ছৃু নাই। অন্ধ একটা পোলা ওহন কি করব। মা কোনোদিন সন্তান ফালাতে পারে না। '  

প্রতিবন্ধী ভাতা হিসাবে তিন মাস পরপর দুই হাজার পাঁচশত টাকা পান লোকমান। ছেলের ভবিষৎ এর কথা চিন্তা করে সকলের সাহায্য সহযোগিতার আহ্বান মা লিলি বেগম।  

news24bd.tv/TR