চার বছর ধরে নিখোঁজ বোন ও ভাগ্নেকে খুঁজছেন তারা

২০১৪ সালের ১২ জুলাই। ঈদ-উল-ফিতরের পরদিন নাটোরের উত্তরা গণভবন দেখতে প্রতিবেশী আব্দুল খলিল ও রাজার সাথে সিংড়া থেকে নাটোর আসেন রিনা খাতুন ও তার ৮ বছরের ছেলে হৃদয়। দিনশেষে তারা আর বাড়ি ফিরে যাননি।  

রিনার পরিবার খলিল ও রাজার কাছে জানতে চাইলে তারা জানায়, ছেলে হৃদয়কে সাথে নিয়ে রিনা পাবনায় তার বোনের বাড়ি গেছে। রিনার পরিবার তাদের কথা বিশ্বাস করে আর খোঁজ নেয়নি।  

এদিকে, দু’দিন পেরিয়ে গেলেও  রিনা ও হৃদয় যোগাযোগ না করায় সন্দেহ হয় তার বড় বোন রহিমা বিবির। এবার ওই প্রতিবেশীদের কাছে জানতে চাইলে তারা জানায়, তার ছোট বোন ও ভাগ্নেকে অনৈতিক কাজের জন্য বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। সেই থেকে সন্তানসহ নিখোঁজ বোন রিনার সন্ধানে আদালত পাড়াসহ দ্বারে দ্বারে ঘুরে ফিরছে অপর দুই বোন রুবিয়া ও রহিমা।  

তাদের সন্ধানে ব্যস্ত থাকার সুযোগ নিয়ে জাল দলিল করে তাদের এক জমিও হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে প্রতিবেশী খলিল ও তার পরিবার।  

এভাবেই সাংবাদিকদের কাছে ৪ বছর আগে ছোট বোন ও ভাগ্নের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে বলছিলেন রিনার বড় বোন রুবিয়া খাতুন।   নিখোঁজ রিনা খাতুন ও তার ছেলে হৃদয়

ঘটনার পর নিখোঁজ দুই জনের সন্ধান চাইলে এক পর্যায়ে ওই প্রতিবেশীরা তাদের খুঁজে এনে দেয়ার অঙ্গীকার করে। তবে দিন যতই যেতে থাকে, ততই টালবাহানা করতে থাকে খলিল ও রাজা। এক সময় নিখোঁজ পরিবারের পক্ষ থেকে চাপ দেয়া হলে রাগন্বিত হয়ে তাদের বাড়িতে হামলা করে খলিল ও তার পরিবার।  

এ ঘটনায় সিংড়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আব্দুল খলিল, তার দুই ছেলে রাজা ও বাদশা এবং স্ত্রী জয়তনের বিরুদ্ধে মামলা করে নিখোঁজ রিনার বোন রহিমা বিবি।  

মামলায় বলা হয়েছে, অভিযুক্তরা রিনা ও হৃদয়কে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করাচ্ছে বা দেশের বাইরে পাচার করেছে বা হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলেছে। এই মামলা দায়েরের পর দীর্ঘ ৪ বছর ধরে অনুসন্ধান চালিয়েও পুলিশ নিখোঁজদের সন্ধান করতে পারেনি।

এদিকে, দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর গেল বছরের নভেম্বরে আব্দুল খলিল গ্রেপ্তার হন। এতে তার সন্তানরা ক্ষিপ্ত হয়ে মামলার বাদী রহিমা বিবির বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় বাড়িতে থাকা তার আরেক বোন রুবিয়া বেগমকেও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে খলিলের স্ত্রী জয়নব।  

রহিমা ও রুবিয়ার অভিযোগ, হামলাকারীরা বাড়িতে থাকা নগদ ৩৭ হাজার টাকা নিয়ে যায় এবং পুনরায় থানায় অভিযোগ করলে হত্যা করা হবে মর্মে হুমকি দেয়। এ ঘটনার পর মামলার বাদীসহ তার পরিবার প্রতিনিয়ত সামাজিকভাবে লাঞ্ছিত হতে থাকে। চলতে থাকে সমঝোতার নামে স্থানীয় সালিশ-বৈঠক।

জানা যায়, ঘটনার পর বাদী ও বিবাদীকে নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন সিংড়া পৌর মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস। এক পর্যায়ে গেল ১১ এপ্রিল সিংড়া পৌরসভার মাধ্যমে স্থায়ী আপোষের ব্যবস্থা করেন মেয়র। নিখোঁজের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে আব্দুল খলিলের ২ শতাংশ জমি বাদী রহিমার পরিবারকে দেয়া হবে মর্মে আপোষনামা প্রস্তুত করেন। আপোষনামায় উভয় পক্ষই স্বাক্ষর করে এবং সম্মত হয় যে, তারা পরস্পরের দায়ের করা সকল মামলা প্রত্যাহার করবেন এবং নিখোঁজ দু’জন ফিরে এলে কেউ কারো বিরুদ্ধে মামলা ও দাবি করতে পারবে না।

এই আপোষনামার ৩ মাস পেরিয়ে গেলেও ভুক্তভোগী পরিবারটি পায়নি প্রতিশ্রুত জমি। উপরন্তু বাদীর পরিবারের ওপর বারবার চড়াও হয় খলিলের পরিবার।

এ ব্যাপারে সিংড়া পৌরসভার মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘ভিকটিম উদ্ধারসহ বিষয়টি মীমাংসার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। উভয়পক্ষের সম্মতিতে সালিশ করা হয়। তারা উভয়েই স্বেচ্ছায় আপোষনামায় স্বাক্ষর করেন। এখন অভিযুক্ত পক্ষ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জমি দিতে চাচ্ছে না এবং বাদী পক্ষও তাদের পরিবারের নিখোঁজ সদস্যদের সন্ধান চাইছে। বিষয়টি জটিল হচ্ছে দিনদিন। এভাবে চলতে থাকলে স্থানীয় মধ্যস্থতা বন্ধ করে আইন অনুযায়ী লড়াই করতে হবে দুই পক্ষকেই।

সিংড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় সালিশে নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াটি ব্যর্থ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নিখোঁজ দু’জনের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া যাবে না। ভিকটিম উদ্ধার না হওয়ায় মামলাটি নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। ভুক্তভোগী পরিবারের সাথে কথা বলে এবং তথ্য নিয়ে নিখোঁজদের সন্ধান করা হচ্ছে।  

নাসিম/অরিন/নিউজ টোয়েন্টিফোর